রাজনৈতিক দলগুলোর অনাগ্রহ ও সীমিত সংরক্ষিত আসনের প্রস্তাবের সমালোচনা করে সংসদে নারীর সরাসরি নির্বাচনের দাবি তুলেছেন নারী অধিকারকর্মীরা। শনিবার (৯ আগস্ট) সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত ‘জাতীয় সংসদে নারী আসন ও নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এই দাবি জানান।
বৈঠকে সংসদে নারী আসন নিয়ে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নাজনীন আখতার এবং সঞ্চালনা করেন সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম অভিযোগ করেন, “সব জায়গায় নারীদের বাদ দেওয়ার এবং পিছিয়ে দেওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট। আমরা ভেবেছিলাম এই সরকার নারীর প্রতি বৈষম্যগুলো বিবেচনায় নেবে, কিন্তু তা হয়নি। যখনই সমান অধিকারের কথা বলা হয়, তখনই হুমকি আসে। বহুদিন ধরে সরাসরি নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। এখন যে ৫ শতাংশ দেওয়ার কথা বলছে, তা হাস্যকর।”
তিনি প্রশ্ন তোলেন, “শুধু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলে নারীদের বিষয়ে কেন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো?” সংস্কার কমিশনে নারী প্রতিনিধিত্বের অভাবের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “ঐকমত্য কমিশন পুরোপুরি ‘বয়েজ ক্লাব’। নারী সংস্কার কমিশন নিয়ে যেভাবে অপমানজনক মন্তব্য হয়েছে, সরকার তার প্রতিবাদে কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি।”
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, “সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারী না থাকলে নারীর পক্ষে আইন প্রণয়ন বা বৈষম্য দূর করা সম্ভব হয় না।” তিনি প্রস্তাব দেন, সংসদের আসন সংখ্যা ৪০০ করা এবং এর মধ্যে ১৫০টি নারী সংরক্ষিত আসন রাখা উচিত। পাশাপাশি সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
তিনি দুটি কারণ উল্লেখ করেন—রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নারীর প্রবেশাধিকার জটিল এবং সমাজে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নারীদের হাতে কম। তার মতে, বিদ্যমান কাঠামোতে রাজনৈতিক দলগুলো কেবল ভারসাম্য রক্ষার জন্য নারীকে সংসদে আনে, যা প্রকৃত ক্ষমতায়নের পথ নয়।
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, “বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালেই নারীর জন্য ৩০ শতাংশ আসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সরাসরি নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দলে থাকা নারীদের প্রস্তুত করতে হবে। কিন্তু দলগুলো বলবে, নারী পাওয়া যাবে না। আসল প্রশ্ন হলো—নির্বাচনের মানদণ্ড কী, ভোটার সেবা নাকি মাস্তানি?”
তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর ৫ শতাংশ সংরক্ষণের প্রস্তাবের সমালোচনা করে বলেন, “এই দয়া-দাক্ষিণ্য কেন? পোশাক খাতে রেমিট্যান্সের অর্ধেকের বেশি অবদান নারীদের। সেখানে মাত্র ৫ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব কেন?”
গোলটেবিল বৈঠকে আরও অংশ নেন নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির, নারীপক্ষের সভানেত্রী গীতা দাস, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপতি তাসলিমা আখতার, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য ইলিরা দেওয়ান এবং শিক্ষার্থী সংগঠক নাজিফা জান্নাত।
বক্তারা বলেন, বর্তমান দলীয় মনোনয়ননির্ভর সংরক্ষিত আসনব্যবস্থায় নারী সংসদ সদস্যদের ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ থাকে না, ফলে ক্ষমতায়ন ও জবাবদিহি সীমিত থাকে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সংরক্ষিত নারী আসন ১০০ করা এবং সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা থাকা উচিত হলেও রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে একমত নয়।
সভা শেষে বক্তারা একমত হন—নারীর প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য সংসদে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারী আসন পূরণ করতে হবে, আসন সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধ্য করতে হবে।