ইতিহাসের এক অন্ধকার পর্বে বাংলাদেশ। দেশে এখন কার্যত নাৎসি শাসন চলছে। আওয়ামী লীগের প্রায় শতভাগ নেতা-কর্মী ঘর ছাড়া। হত্যা, ধর্ষণ, গুম, অগ্নি সংযোগ, লুটপাট, মামলা, হামলা, গ্রেফতার, দখল, মব, চাঁদাবাজি, সংখ্যালঘু নির্যাতন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস, গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ..... চলছেই। এমন নৈরাজ্যময় পরিস্থিতির উদাহরণ বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। আওয়ামী লীগ সমর্থক যে ৩৫ শতাংশ ভোটার রয়েছে তাদের জীবনও সংকটাপন্ন। মুক্তচিন্তক বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষও আজ বিপন্ন।
এদের বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ নেই। বুদ্ধিজীবী মহল নীরব। গণমাধ্যমে যে দু'একজন কথা বলছে তারাও গ্রেফতার হচ্ছে। বিএনপি ক'মাস আগেও টুকটাক প্রতিবাদ জানালেও তারেক-ইউনূস বৈঠকের পর তারাও মুখে কুলুপ এঁটেছে। কেননা ফ্রেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের নিশ্চয়তা তারা পেয়েছে। এবং প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে যেহেতু তারা কোন ফর্মেই নির্বাচন করতে দিবে না, তাহলে বিএনপিকে আর ঠেকায় কে?
মেটিকুলাস ডিজাইনের মাধ্যমে হলেও জনরোষের মুখেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। এই সত্যটা যদিও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মানতে রাজী নয়। কিন্তু এর বিপরীত বাস্তবতা হলো গত এক বছরের নাৎসি শাসন আওয়ামী লীগের অপশাসনকে এমনভাবেই অতিক্রম করেছে যে 'আগেই ভালো ছিলাম' এই উপলব্ধি ক্রমান্বয়ে তৈরি হচ্ছে জনমনে।
তাহলে আওয়ামী লীগ এখন কী করবে? আগে একটু দেখি আওয়ামী লীগ গত এক বছর কী করেছে! আওয়ামী লীগ প্রধান যে কাজটি করেছে সেটি হচ্ছে ভার্চুয়ালি সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। এর পাশাপাশি ঝটিকা মিছিল, মিটিং ও গোপন কর্মসূচি। শেখ হাসিনা তার জীবদ্দশার সেরা রাজনীতি করছেন এখন- সেটা হচ্ছে 'সরাসরি তৃণমূলের কাছে যাওয়া'।
তৃণমূল তো দূরের কথা গত ১৫ বছর দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দও নেত্রীর কাছে ভিড়তে পারেনি, মনখুলে কথা বলতে পারেনি। সামরিক-বেসামরিক দেয়ালে বন্দী ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো ছিল কার্পেট দিয়ে মোড়ানো, যার নীচটা অসংখ্য গর্ত-খানা-খন্দে ভরা। ঢাকা মহানগরীতে মূল দল বা কোন সহযোগী সংগঠনই কোনো ইউনিট, ওয়ার্ড বা থানা কমিটি করতে পারেনি গত ১৫ বছর। কমিটি বাণিজ্য ও গ্রুপিং-লবিং নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ, যে খবর শেখ হাসিনার কানে পৌঁছায়নি কখনও।
তার উপর দুর্নীতি, ব্যাংক লুট ও শেখ ডাইনেস্টি'র একচ্ছত্র আধিপত্য। গত ১৫ বছরের অপরাজনীতির ধারাবাহিকতায় ক্ষমতা হারানোর পর শেখ হাসিনা এখন প্রতিদিন একাধিকবার তৃণমূলের সাথে ভার্চুয়াল বৈঠক করছেন। সরাসরি কথা শুনছেন সকল স্তরের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এখন যথেষ্ট এক্টিভ। এছাড়া বিভিন্ন দিবস ও ইস্যু উপলক্ষে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত ঝটিকা মিছিল চলছে। গোপালগঞ্জে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ ছিল দখলদারদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় চপেটাঘাত ও এরমধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আশার আলো প্রতিফলিত হয়েছে।
ভার্চুয়াল মিটিংয়ের বাইরে মিডিয়াতে অসমর্থিত সূত্রে খবর এসেছে শেখ হাসিনা দিল্লীতে ৬ জন শীর্ষ নেতার সাথে বৈঠক করেছেন। সেখানে তিনি একটি বার্তা দিয়েছেন "নো আওয়ামী লীগ, নো ইলেকশন"। এখন এই স্ট্র্যাটেজি দেশ ও দলকে কোথায় নিয়ে যাবে- সেটাই দেখার বিষয়।
৫ আগষ্ট জুলাই সনদ ঘোষণার পর ফ্রেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের নির্দেশনা দেন ড. ইউনূস। এর প্রেক্ষিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং তিনি বলেছেন, 'আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ভোট দিতে পারবেন'! নাৎসি সরকার চাইলে আওয়ামী সমর্থক ৩/৪ কোটি ভোটারের ভোটাধিকারও কেড়ে নিতে পারতেন! তাদের উদারতার কারণে সেটা করছেন না। কিন্তু কোন ফরম্যাটেই আওয়ামী লীগকে দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে দিবে না। ব্যালটে নৌকা প্রতীকও এবার থাকছে না। স্বতন্ত্রভাবে আওয়ামী লীগের নেতারা নির্বাচন করতে পারবে কিনা সে বিষয়েও কোন উত্তর দেননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তবে সেটা ঠেকানো সম্ভব বলে মনে হয় না।
"নো আওয়ামী লীগ, নো ইলেকশন" এই স্ট্র্যাটেজি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে দলের জন্য। আওয়ামী লীগের এখন উচিত স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া।
পাকিস্তানে '২৪ এর ৮ ফেব্রুয়ারিতে যে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে সেখানে ইমরান খানের দল পিটিআই নিষিদ্ধ ছিল। দলীয় প্রতীকও ছিল না। ইমরান খান জেল থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কারাবন্দী অবস্থায় তিনি ভার্চুয়াল বক্তৃতা দিয়েছেন বিভিন্ন জনসভায়। তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ রুখতে পারেনি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ফলাফল ১০১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী পাশ করলো যার মধ্যে ৯৩ জনই ইমরানের দল পিটিআই-এর। নেওয়াজের মুসলিম লীগ ৭৫, বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপিপি ৫৪।
পাকিস্তানের পরিস্থিতি আর বাংলাদেশ এক নয়। তবে এখানেও সুবিধা-অসুবিধা দুটোই রয়েছে। এখানে প্রধান সুবিধা হল আওয়ামী বিরোধী যতগুলো দল রয়েছে তারা সবাই আগের চেয়ে শক্তিশালী। বিএনপি, জামাত, চরমোনাই সবাই এখন আগের তুলনায় বেশ সংহত। এরসাথে যুক্ত হয়েছে এনসিপি। বাম সংগঠন, গণ অধিকার, গণশক্তি, গণসংহতি এ দলগুলো ভোটের হিসেবে ধর্তব্য নয়। তারচেয়ে বহুধাবিভক্ত জাতীয় পার্টি অনেক আসনে মূল ফ্যাক্টর। এন্টি আওয়ামী লীগের ভোট ৪/৫টি পাত্রে ভাগ হবে। সংখ্যালঘু ভোটসহ আওয়ামী লীগের যে ৩৫ শতাংশ ভোট রয়েছে তার অর্ধেক ভোটও যদি আওয়ামী লীগ সমর্থিত কোন স্বতন্ত্র প্রার্থী পায় তা এবারের নির্বাচনে জয়ী হবার জন্য যথেষ্ট। ইমরান খান জেল থেকে যেভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছেন, শেখ হাসিনা তারচেয়ে নিবিড়ভাবে পরিচালনা করতে পারবেন।
তবে প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে মনোনয়ন বাছাই। প্রয়োজনে ২য় স্তরের নেতৃত্ব থেকে ক্লিন ইমেজের প্রার্থী বাছাই করতে হবে। কারাবন্দী থেকেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, যতক্ষণ না কনভিক্টেড হচ্ছে। এরপর প্রধান চ্যালেঞ্জ নির্বাচনী প্রচারণা। সকল দল একত্রিত হয়ে 'ফ্যাসিস্ট ঠেকাও' প্রচারণায় নামবে। নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে না। অত্যাচার-নির্যাতন সইতে হবে। ফিজিক্যালি না হলেও ভার্চুয়ালি তৃণমূল ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে হবে।
কেউ মানুক বা নাই মানুক এবারের নির্বাচন অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অংশগ্রহণমূলক না হলেও ফ্রি-ফেয়ার হবে। কেননা সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন যন্ত্র কোন দলকেই বিশেষ কোন ফেভার দিবে না। স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রচারণা করতে পারুক বা না পারুক ভোট প্রদান যদি নিশ্চিত করা যায় তবে আশাতীত ফলাফল আসতে পারে।
একমাত্র স্বতন্ত্র নির্বাচনের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান প্রমাণ করতে পারে। নির্বাচনের সময় যে দমন-পীড়ন চলবে তা জাতীয় গণমাধ্যমে না আসলেও আন্তর্জাতিকভাবে ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হবে না। চোরা-গুপ্তা মিছিল, ভার্চুয়াল মিটিং, আর 'নো আওয়ামী লীগ নো ইলেকশন ক্যাম্পেইন' কতটুকু ফল দিবে?