সর্বশেষ

ইলিশঃ জাতীয় মাছ না, জাতীয় মানদণ্ড

প্রকাশিত: ১৩ অগাস্ট ২০২৫, ১৩:২৭
ইলিশঃ জাতীয় মাছ না, জাতীয় মানদণ্ড

ইলিশ মাছ, যাহা এককালে পদ্মা-মেঘনার ঢেউ ছুঁয়ে গৃহস্থের পাতের অলংকার ছিল, আজ তাহা জাতীয় মাছ নহে, জাতীয় মানদণ্ডে পরিণত হইয়াছে। ইহা কেবল খাদ্য নহে, ইহা এক সামাজিক পরিচয়পত্র, এক শ্রেণীচিহ্ন, এক লজ্জার সীমারেখা।

 

বর্তমানে এক কেজি ইলিশের মূল্য যাহাতে ২৫ কেজি চাল কিংবা চার কেজি গরুর মাংস নচেৎ একমাসের মাছের বাজার অথবা দুই কেজি খাসি এবং সাথে আস্ত দুইটি খাশির মস্তক ক্রয় সম্ভব। অর্থাৎ, ইলিশ ক্রয় মানেই এক মাসের খাদ্যসামগ্রীর বাজেটের উপর দণ্ডবৎ আঘাত। ফলে, ইলিশ কিনিলে মানুষ সন্দেহ করে—“বেটার নিশ্চয়ই ঘুষের টাকা আছে, অথবা চুরির বিকল্প উৎস!” যে ইলিশ বিক্রয় করে, সে বিব্রত;

 

যে ইলিশ ক্রয় করে, সে লজ্জিত। বাজারে ইলিশের পাশে দাঁড়ানো মানেই সামাজিক জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হওয়া। “ভাই, এত দামি মাছ কিনতেছেন? কিছু হইছে নাকি?”—এই প্রশ্নে ক্রেতা যেন অপরাধী, বিক্রেতা যেন ষড়যন্ত্রকারী।

 

ইলিশ আজ শ্রেণীবিন্যাসের এক নিঃশব্দ অথচ দৃঢ় মানদণ্ড। যাহারা ইলিশ খায়, তাহারা সমাজে কূলীন; যাহারা খায় না, তাহারা জাতপাতহীন, বেশরম, মজলুম। ইলিশ খাওয়া মানেই সামাজিক মর্যাদা অর্জন। ইলিশহীন জীবন মানেই নিম্নবর্গীয় অস্তিত্ব।

 

এক সময় ছিল, বৃষ্টির দিনে ইলিশ ভাজা ও খিচুড়ি ছিল বাঙালির আবেগ। এখন ইহা বিলাসিতা। ইলিশের গন্ধে প্রতিবেশী জানালা বন্ধ করে, কারণ তাহা ঈর্ষার উদ্রেক করে। ইলিশ খাওয়া এখন গোপনীয়তা রক্ষা করিয়া করতে হয়, যেন রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ।

 

ইলিশের দাম বাড়িলে অর্থনীতিবিদ বলেন, “মুদ্রাস্ফীতি!” কিন্তু সাধারণ মানুষ বলেন, “মানুষের সীমা ছাড়াইয়া গেছে।” ইলিশ এখন কেবল মাছ নহে, ইহা এক জাতীয় পরীক্ষা। কে কতটা সাহসী, কে কতটা বিত্তবান, কে কতটা নির্লজ্জ—ইলিশ তাহা নির্ধারণ করে।

 

ইলিশের প্রতি জাতীয় প্রেম আজ ব্যঙ্গের বস্তু। যাহারা ইলিশ খায়, তাহারা ছবি তোলে, পোস্ট করে—“আজকের লাঞ্চ!” যাহারা খায় না, তাহারা সেই পোস্টে রাগে রিঅ্যাক্ট দেয়। ইলিশ এখন সামাজিক মিডিয়ার স্ট্যাটাস সিম্বল।

 

সুতরাং, ইলিশ মাছ নহে, ইহা এক জাতীয় মানদণ্ড। ইলিশ আমাদের লজ্জা, আমাদের অহংকার, আমাদের বিভাজন। ইলিশ খাওয়া মানেই জাতীয় শ্রেণী উত্তরণ। আর না খাওয়া মানেই—“ভাই, আপনার তো এখনো মানুষ হইবার বাকি!” 

 

লেখক: একটি ক্লান্ত পেনসিল, যে তাহার বিপন্ন সময়কে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখে

নাগরিক কথা থেকে আরও পড়ুন
সব খবর