১৯৭০ সাল। স্বাধিকারের দাবি ছাপিয়ে ছাত্ররা ততদিনে স্বাধীনতার কথা বলতে শুরু করেছে। এমন উত্তাল সময়ে ঐতিহাসিক ৬ দফা নিয়ে ঢাকায় একটি সিনেমা বানানো হয়। নাম ‘জয় বাংলা’।
সিনেমাটি পরিচালনা করেন ফখরুল আলম। সে বছরই তার প্রযোজনায় মুক্তি পেয়েছিল নিরীক্ষামূলক ছবি ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’। পাশাপাশি তার আরেকটি পরিচয় ছিল। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে ছিলেন ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের অবিসংবাদিত ছাত্রনেতা।
তবে সিনেমাটির মূল পরিকল্পনা ছিল শেখ ফজলুল হক মণির। ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে। কিন্তু মাঠের রাজনীতিতে সাংগঠনিক দক্ষতায় ছাপিয়ে গিয়েছিলেন সে পরিচয়। ষাটের দশক থেকেই চার ছাত্রনেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য গোপনে কাজ করে যাচ্ছিলেন। তাদেরই একজন তিনি। ৬ দফা আন্দোলনে পালন করেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। সেজন্য কারাবরণও করতে হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছিল ৮টি মামলা। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে অন্যান্যদের সঙ্গে তিনিও কারামুক্ত হন। আর তারপরই এই চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হন।
নাম তারা আগেই ঠিক করে ফেলেন। ‘জয় বাংলা’। পরিকল্পনাটি ছিল সময়ের চেয়ে বেশ অগ্রসর। ৬টি গল্প নিয়ে অমনিবাস ফিল্ম। প্রতিটি গল্প ৬ দফার একেকটি দাবির প্রতিনিধিত্ব করবে। উঠে আসবে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ আর পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার ইতিহাস।
এই জটিল আখ্যানের বুনন তৈরির জন্য চট্টগ্রাম থেকে ডেকে আনা হয় কবি মাহবুব তালুকদারকে। দ্রুত কাজ শেষ করতে চারটি গল্প তৈরি হতেই শুরু করা হয় শুটিং। কাজ চলতে থাকে গানেরও। গাজী মাজহারুল আনোয়ার লেখেন বিখ্যাত ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’। সুর করেন আনোয়ার পারভেজ। কণ্ঠ দেন আবদুল জব্বার ও শাহনাজ রহমতুল্লাহ।
জুনেই ‘জয় বাংলা’ সেন্সর ছাড়পত্রের জন্য জমা দেয়া হয়। পরিবেশনার দায়িত্ব নেন বিশিষ্ট পরিচালক সালাহ্উদ্দিন। আসন্ন মুক্তি উপলক্ষ্যে ২৫ জুন আয়োজন করা হয় সংবাদ সম্মেলন। তাতে উপস্থিত ছিলেন ঢাকার ডাকসাইটে সব সাংবাদিক।
পরদিন প্রায় সব পত্রিকায় ‘জয় বাংলা’র খবর ছাপা হয়। সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে ছাপায় জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র হিসেবে পরিচিত দৈনিক সংগ্রাম। প্রথম পাতায় চার কলামে। ‘অভিযোগ’ তোলে ছবিটিতে ৬ দফা, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে ‘উস্কানি’ দেয়া হয়েছে। দুই দিন পরে তারা ছবিটির বিরুদ্ধে ‘ছায়াছবিতে রাজনীতি’ শিরোনামে দুই কলামের দীর্ঘ সম্পাদকীয় ছাপে। সে ধারাবাহিকতায় ইসলামী মৌলবাদী দলগুলো ছবিটির বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে শুরু করে।
এই সুযোগে পাকিস্তানি সামরিক সরকার ‘জয় বাংলা’কে সেন্সর ছাড়পত্র আটকে দেয়। তবে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি ঠিকই ঠাঁই করে নেয় স্বাধীনতাকামী বাঙালির হৃদয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার হয় নিয়মিত।
১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কুরবানির ঈদ। সে উপলক্ষ্যে চলে চারটি ছবি। দুইটি পুরনো। ‘মধুমিলন’ আর ‘ময়নামতি’। একটি ‘প্রায়’ নতুন। ‘মানুষের মন’ মুক্তি পেয়েছিল দুই সপ্তাহ আগে। ১৪ জানুয়ারি। স্বাধীনতার পর মুক্তি পাওয়া সেটিই প্রথম ছবি। আর দ্বিতীয় ছবি হিসেবে সেই ঈদে মুক্তি পায় ‘জয় বাংলা’।