সর্বশেষ

‘সাইয়ারা’ — ভারতীয় সিনেমায় আবেগের সুনামি

প্রকাশিত: ১৬ অগাস্ট ২০২৫, ০১:১৩
‘সাইয়ারা’ — ভারতীয় সিনেমায় আবেগের সুনামি

ভারতের সিনেমা জগতে প্রতি বছর শত শত ছবি মুক্তি পায়, কিন্তু কিছু সিনেমার গল্প যা শুধু বিনোদন নয়, এক সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আবেগীয় ঘটনাতে পরিণত হয়। ২০২৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সাইয়ারা’ সেই বিরল ঘরানার অন্তর্গত। যে চলচ্চিত্র শুধু বক্স অফিসে রেকর্ড ভেঙে দেয়নি বরং দর্শকদের মানসের গভীরে প্রবল নাড়া দিয়েছে। মুক্তির পর থেকে ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়া, সংবাদপত্র, টেলিভিশন সবখানে এর আলোচনা তুঙ্গে।
 

গল্পের আবেগঘন শক্তি — প্রচলিত বলিউড রোমান্স বা অ্যাকশন কাহিনীর বাইরে গিয়ে সাইয়ারা এমন এক প্রেম কাহিনী তুলে ধরেছে যা সময়, সংস্কৃতি ও সামাজিক বাঁধার বিরুদ্ধে এক মহাকাব্যিক সংগ্রামের প্রতীক।
 

মুক্তির প্রথম সপ্তাহ থেকেই দেখা গেছে, সিনেমা হলের বাইরে দীর্ঘ সারি, হলের ভেতরে কান্নার আওয়াজ, কেউ কেউ আবেগে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া—যা ভারতীয় সিনেমায় বিরল ঘটনা। এর কারণ, ব্যক্তিগত আবেগের প্রতিফলন। গল্পের চরিত্ররা এমন সংকটের মধ্য দিয়ে যায় যা অনেক দর্শকের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে মিলে যায়। এমন ঘটনায় ভারতীয় সাংস্কৃতিক সংযোগকেও উপেক্ষা করা যায় না। এই সিনেমার গল্প গভীরভাবে ভারতীয় আবেগ, সম্পর্কের জটিলতা এবং পারিবারিক দায়বদ্ধতার সঙ্গে যুক্ত। 

 

গল্পে কোন খল নায়ক নেই। চরিত্রদের ভেতরের দ্বন্দ্ব, সামাজিক চাপ ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ফলাফল এই সিনেমাকে বলিউডের অন্য সব চলচ্চিত্র থেকে আলাদা করেছে। ফলে, দর্শকরা নিজেদের আবেগের বোঝা এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ঝেড়ে ফেলতে পেরেছে; যা এক ধরনের মানসিক মুক্তি। সিনেমা হলে একসাথে এতজন একই আবেগে ভেসে যাওয়ায় এটি এক ধরনের সম্মিলিত শোক ও আনন্দের অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
 

এই সিনেমা দেখে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ ঘাই বলেন, “Gen Z আর রোমান্সে কান্না করে না— এ ধারণা এই সিনেমা ভেঙে দিয়েছে; চারপাশের প্রতিক্রিয়া দেখেই বুঝা যায়, সবাই অন্য মাত্রার আবেগ অনুভব করছে। যা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বেশ বিরল!”
 

যেখানে আজকাল বলিউডে ১০০ দিনের প্রচারণা, ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং ও সামাজিক মাধ্যমে হাইপ তৈরি হয়, সেখানে ‘সাইয়ারা’ ঠিক উল্টো পথে হেঁটেছেন। মুক্তির আগে এই সিনেমা নিয়ে তেমন কোন প্রচার হয়নি; বরং হলফেরত দর্শকদের প্রতিক্রিয়াই হল এই সিনেমার সব থেকে বড় প্রচার কৌশল! ছোট ছোট টিজার, গান প্রকাশ, আর পরিচালকের নীরব আত্মবিশ্বাস।  
 

প্রথম সপ্তাহেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দর্শকদের কান্না, থিয়েটারে চিৎকার, কেউ প্রেমিকাকে কোলে তুলে নাচছেন, কেউ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হাত না ছাড়ার এবং উত্তেজনায় দর্শকদের হাততালি, সামাজিক মাধ্যমে এই ভিডিও ভাইরাল হয়। এরপর মুখে মুখে প্রচার, বন্ধুদের মুখে শোনা গল্পই সবচেয়ে বড় পোস্টার হয়ে দাঁড়ায়। একটা নতুন জুটি পর্দায়। তাঁদের প্রেম, তাঁদের রসায়ন দেখে আবেগে বুঁদ গোটা ভারত। এই চলচ্চিত্রের গল্পে এমন কিছু মুহূর্ত আছে যা প্রেম, হারানো বা অপূর্ণতার ব্যক্তিগত স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে। অনেকে নিজেদের অতীত সম্পর্কের সঙ্গে মিল খুঁজে পান।


‘সাইয়ারা’ বক্স অফিসে শুধু সাফল্যের গল্প নয়, এটি প্রমাণ করেছে যে, সঠিকভাবে বলা হলে  গভীর ব্যক্তিগত গল্পও বৃহত্তর দর্শককে একত্রিত করতে পারে। ভারতীয় মূলধারার অনেক সীমাবদ্ধতাকে ভেঙে দিয়ে এই সিনেমা এক নতুন ধারার পথ দেখিয়েছে,যেখানে  হৃদয়ই  আসল নায়ক।
 

 

শেষ এই ধরনের একটা উন্মাদনা দেখা গিয়েছিল শাহরুখ খানের ‘জওয়ান’ সিনেমা নিয়ে। সেটা হওয়ারই ছিল। কারণ, শাহরুখ খানের মতো তারকার ছবি সেটা। কিন্তু একেবারে নতুন জুটি নিয়ে সিনেমা। আর প্রথম দিনে ২১ কোটির ব্যবসা এর আগে অন্য কোনও নবাগত দিতে পারেনি। এই সিনেমা এতটা ব্যবসা করার পিছনে কারণ, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিটা শো-এ দর্শক আসছে এবং এই সিনেমা বার বার দেখছেন দর্শক। নিঃসন্দেহে ‘সাইয়ারা’ এই বছরের এখন অবধি সবচেয়ে বড় ওপেনিং। 
 

যদিও আকাশচুম্বী সাফল্য নিয়েও ‘সাইয়ারা’ বিতর্কমুক্ত নয়। কিছু সমালোচক অভিযোগ তুলেছেন যে, সিনেমার কিছু দৃশ্য কোরিয়ান সিনেমা A Moment to Remember-এর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ দর্শক প্রতিক্রিয়াকে কেউ কেউ ‘প্ল্যান্টেড মার্কেটিং’ মনে করছেন—যদিও প্রযোজকরা তা অস্বীকার করেছেন।


‘সাইয়ারা’ একটি সামাজিক ঘটনা, যা প্রমাণ করে সিনেমা এখনও মানুষের ব্যক্তিগত অনুভূতিকে নাড়াতে পারে। এটি হয়তো গল্পে বিপ্লব ঘটায়নি, কিন্তু আবেগে ঘটিয়েছে। প্রচলিত ভারতীয় চলচ্চিত্র সংস্কৃতিতে এটি সেই বিরল মুহূর্ত—যখন একসঙ্গে কয়েক কোটি মানুষ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে থেকেও একই কাহিনি শুনে কেঁদেছে, হাততালি দিয়েছে, আর অনুভব করেছে—প্রেম এখনো বেঁচে আছে।

 

‘সাইয়ারা’ শুধু একটি সিনেমা নয়—এটি সমষ্টিগত আবেগের এক বিস্ফোরণ, যা ভারতীয় সিনেমায় দীর্ঘদিন দেখা যায়নি। এর সাফল্য প্রমাণ করছে, দর্শকরা এখন আর কেবল ফর্মুলামাফিক বিনোদন চান না; তারা এমন গল্প পছন্দ করেন যা তাদের হৃদয়ে দীর্ঘস্থায়ী দাগ কাটে।

সব খবর