সর্বশেষ

সিনেমা

‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’- ভারতে মুক্তির আগেই বিতর্ক

প্রকাশিত: ২৩ অগাস্ট ২০২৫, ০২:৩৪
“এটি কোনো সিনেমা নয়, এটি একটি রাজনৈতিক ভিডিও যা নির্বাচনী রাজনৈতিক অ্যাসাইনমেন্টের অংশ হিসেবে তৈরি। পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী তার বিবেক বিজেপির কাছে বন্ধক রেখেছেন।”— তৃণমূল কংগ্রেস নেতা কুনাল ঘোষ
‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’- ভারতে মুক্তির আগেই  বিতর্ক

বিবেক অগ্নিহোত্রীর নতুন সিনেমা ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে শুরু থেকেই তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক। সিনেমার ট্রেলার প্রকাশকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় এসব বিতর্ক। ১৬ আগস্ট ২০২৫, যেদিন ১৯৪৬ সালের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ পালিত হয়েছিল, সেদিন কলকাতায় সিনেমাটির ট্রেলার মুক্তির অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রথমে একটি মাল্টিপ্লেক্স অনুষ্ঠান বাতিল করে, পরে একটি পাঁচতারা হোটেলেও অনুষ্ঠানে বাধা আসে। এই সিনেমার পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী অভিযোগ করেন, “কলকাতা পুলিশ আমাদের ট্রেলার লঞ্চ বন্ধ করে দিয়েছে। এটি একনায়কত্ব, এটি ফ্যাসিবাদ। একটি সিবিএফসি অনুমোদিত সিনেমার ট্রেলার লঞ্চ বন্ধ করা হয়েছে সবার সামনেই। আমার কণ্ঠস্বর দমানো যাবে না।”


তৃণমূল কংগ্রেস নেতা কুনাল ঘোষ পরিচালক অগ্নিহোত্রীর তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, “এটি কোনো সিনেমা নয়, এটি একটি রাজনৈতিক ভিডিও যা নির্বাচনী রাজনৈতিক অ্যাসাইনমেন্টের অংশ হিসেবে তৈরি। পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী তার বিবেক বিজেপির কাছে বন্ধক রেখেছেন।” ঘোষ আরও বলেন, “তাকে ‘গোধরা ফাইলস’, ‘মণিপুর ফাইলস’, ‘উত্তরপ্রদেশ ফাইলস’ তৈরি করতে কে বাধা দিচ্ছে? সে বাংলাকে কালিমালিপ্ত করতে এসেছে।” 
 

এই সিনেমার প্রভাব ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া কি কি হতে পারে সে বিষয়ে অনেকেই চিন্তিত। বিশেষ করে ,ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে অনেকে। 
 

তবে, এইসব আশংকার কথা নাকচ করে দিয়েছেন পরিচালক অগ্নিহোত্রী। তিনি বলেন, “সিনেমাটি ইতিমধ্যেই সেন্সর বোর্ডের অনুমোদন পেয়েছে। এটি আমেরিকার ১২টি শহরে প্রদর্শিত হয়েছে। কেউ ভাবতে পারে এটি অশান্তি সৃষ্টি করবে, কিন্তু আমি বলব এটি শুধুই ‘সত্য’।”
 

এদিকে, পরিচালকের কথার সুরে তাল মিলিয়ে কেউ কেউ বলছেন, তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে কেন এত এত সিনেমা বানানো হলো? ইহুদীদের যারা পাইকারী হারে হত্যা করেছিল তাদেরকে আজো সিনেমায় দেখানোর সময় কি কেউ বলে এসব বিভেদ বাড়িয়ে তুলবে?
 

এই সিনেমায় ঐতিহাসিক চরিত্র বিকৃতির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। সিনেমার ট্রেলার প্রকাশের পর থেকেই গোপাল মুখোপাধ্যায়, যিনি ‘গোপাল পাঁঠা’ নামে পরিচিত ছিলেন, তাঁর পরিচয় বিকৃত করার অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগে ছবির পরিচালক বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রীর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছেন গোপালবাবুর নাতি শান্তনু মুখোপাধ্যায়। ট্রেলারে গোপাল মুখোপাধ্যায়কে ‘এক ছিল কসাই গোপাল পাঁঠা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। শান্তনুর অভিযোগ, “আমাদের কোনও অনুমতি নেওয়া হয়নি। আমার ঠাকুরদা পেশায় কসাই ছিলেন না। তিনি ছিলেন কুস্তিগীর এবং অনুশীলন সমিতির একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। এটা ইতিহাস বিকৃতি ও অসম্মানজনক।” পরিবার জানায়, তিনি মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক ছিলেন না বরং অনেক মুসলিম পরিবারকে তিনি রক্ষাও করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “নিরীহ কোনও মুসলিম বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা মহিলাদের কেশ ছোঁয়া যাবে না।”
 

এই সিনেমায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়কে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দেখা গিয়েছে। এইসব বিতর্ক নিয়ে এই সিনেমার অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় বলেন, তিনি ইতিহাসবিদ নন—অতএব চলচ্চিত্রের ঐতিহাসিক সঠিকতা নিয়ে মন্তব্য করতে পারবেন না। শাশ্বত আরও বলেন, তিনি শুধুমাত্র তার চরিত্র বুঝে অভিনয় করেছেন, পুরো গল্প জানা ছিল না—এমনকি ‘দিল্লী ফাইলস’ থেকে ‘বেঙ্গল ফাইলস’ নাম পরিবর্তন নিয়েও তার কোনো ধারণা ছিল না। এই সিনেমায় শাশ্বত মুর্শিদাবাদের এক বিধায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
 

‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ সিনেমার ভিত্তি আছে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে (১৯৪৬-এর দাঙ্গা), কিন্তু মৃত্যুর সংখা ও চরিত্রের উপস্থাপনে বিদ্যমান বিতর্ক বলে দেয় সাম্প্রতিক গবেষণায় মনে হয় অবিশুদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। ট্রেলার মুক্তিতে বাঁধা, তৃণমূল-বিজেপি উত্তেজনা, মুক্তির পেছনে নির্বাচন—সব মিলিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িত থাকার সম্ভাবনা প্রবল। গোপাল মুখার্জি ও তার পরিবারের অভিযোগ সত্য হলে, এটি ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠতা ও সম্মানের বিরোধী।
 

এমন দ্বিমুখী বিতর্কের মুখে দাঁড়িয়ে একদিকে এই সিনেমা ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়কে সামনে আনার চেষ্টার পরিচায়ক, অন্যদিকে এই পথে বহু বিকৃতি ও রাজনৈতিক প্রভাব— প্রেক্ষাপট এবং উদ্দেশ্য প্রশ্ন তোলে-এটি ইতিহাসের প্রাঞ্জলতায় নির্মিত নাকি রাজনৈতিক বেলুনে দম?


একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “হিন্দু যুবসমাজ যেন তাদের ইহুদি সমকক্ষদের মতো তিক্ততায় নয়, সচেতনতায় বেড়ে উঠে। যাতে তারা ইতিহাসকে বোঝা হিসেবে নয়, ঢাল হিসেবে বহন করে।”
 

‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক, একটি বিষয় স্পষ্ট যে এই সিনেমা ইতিহাসের একটি অন্ধকার অধ্যায়কে সামনে এনেছে। ১৯৪৬ সালের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ এবং তার পরবর্তী দাঙ্গা নিঃসন্দেহে ভারতীয় ইতিহাসের একটি ভয়াবহ ঘটনা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, সিনেমার মাধ্যমে এই ইতিহাসের উপস্থাপনা কতটুকু নিরপেক্ষ এবং কতটুকু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ প্রসঙ্গে পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী  বলেন—“স্মৃতিই হলো বেঁচে থাকা”। 
 

স্মৃতি যেন বিভাজনের হাতিয়ার না হয়ে, ঐক্যের পথ হয় । সেটাই প্রত্যাশা। ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’-এর মুক্তি ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, তখনই স্পষ্ট হবে এটি ইতিহাসের সত্য উদ্ঘাটন নাকি রাজনৈতিক এজেন্ডার প্রচার।

সব খবর