সর্বশেষ

বাংলাদেশঃ ডিজিটাল যুগে মতপ্রকাশ ও নির্বাচনী স্বচ্ছতার সুরক্ষা

Md Ahad পাবনা
প্রকাশিত: ৬ অগাস্ট ২০২৫, ১২:৫৭
এক যৌথ বিবৃতিতে ARTICLE 19 এবং আরও ৩০টি নাগরিক সংগঠন ২০২৪ সালের জুন মাসে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ৫৯তম অধিবেশনের প্রাক্কালে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের উপর নিপীড়ন এবং নির্বাচনী স্বচ্ছতার গুরুতর অবনতির বিষয়টি তুলে ধরে। এতে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাইবার নিরাপত্তা আইন, সাংবাদিকদের উপর হামলা, নারী সাংবাদিকদের প্রতি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিটি ১০ দফা সুপারিশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়।
বাংলাদেশঃ ডিজিটাল যুগে মতপ্রকাশ ও নির্বাচনী স্বচ্ছতার সুরক্ষা

২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সাংবাদিকতার নিরাপত্তা ও নির্বাচনী স্বচ্ছতার অবনতির বিষয়টি তুলে ধরে এবং জরুরি আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ৫৯তম অধিবেশনের প্রাক্কালে ARTICLE 19 এবং আরও ৩০টি নাগরিক সংগঠন একটি যৌথ বিবৃতি জমা দেয়। বিডিভয়েসের পাঠকদের জন্য আমরা বিবৃতিটি হুবহু প্রকাশ করছি।

 


 

আমরা, নিচে স্বাক্ষরকারী নাগরিক সমাজের সংগঠনসমূহ, বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি এবং নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে মতপ্রকাশের অধিকারের লঙ্ঘন বিষয়ে ৫৯তম অধিবেশনের আগে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে এই যৌথ বিবৃতি জমা দেওয়ার সুযোগকে স্বাগত জানাচ্ছি। ২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকে দেশটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নাগরিক পরিসর নিয়ে চলমান হুমকির মুখে রয়েছে, যা তাৎক্ষণিক ও টেকসই আন্তর্জাতিক মনোযোগ দাবি করে।

 

আমরা বিশেষ প্রতিবেদকের সময়োপযোগী প্রতিবেদনকে স্বাগত জানাই, যা বর্তমান ডিজিটাল প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের সময় মতপ্রকাশের অধিকার এবং গণতন্ত্র রক্ষার জন্য বিশ্বব্যাপী সরকারসমূহের সামনে একটি স্পষ্ট পথরেখা তুলে ধরে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও, এসব অধিকার এখন ক্রমাগতভাবে দমনমূলক আইন, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও সাংবাদিক ও মতবিরোধীদের ওপর আক্রমণের মাধ্যমে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

 

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ডিজিটাল নিপীড়ন

 

২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (DSA) কার্যকর হওয়ার পর বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ARTICLE 19 মোট ৭৩৬টি DSA মামলা নথিভুক্ত করেছে, যার মধ্যে ১৩৫টি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে, এবং এতে ১,৩০০-এর বেশি অভিযুক্ত ও ৪২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়—যাদের মধ্যে ২৬৭ জন সাংবাদিক ছিলেন। এই আইন দুর্নীতি ও নির্যাতনের প্রতিবেদনকারী সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এবং সাধারণ নাগরিকদের ভয় দেখাতে এবং চুপ করাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

 

২০২৩ সালে সরকার DSA বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন (CSA) প্রণয়ন করে, যদিও নতুন আইনে আগের অনেক দমনমূলক ধারা রাখা হয়। জুলাই ২০২৪-এ গণতান্ত্রিক 'জুলাই অভ্যুত্থান'-এর পর CSA বাতিলের প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বরং, সম্প্রতি নতুন মামলাও দায়ের করা হয়েছে। আগস্ট ২০২৪-এ গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশ’ অনুমোদন করলেও কিছু ধারা এখনও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করছে বলে উদ্বেগ রয়ে গেছে।

 

২০২৪ সালের নিপীড়নের চিত্র

  •  

ARTICLE 19 ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে ২৩২টি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ঘটনা নথিভুক্ত করে, যেগুলোর ভুক্তভোগী ৩৩৭ জন সাংবাদিক, ১৩ জন মানবাধিকার কর্মী এবং ১১৮ জন সাধারণ নাগরিক। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে শারীরিক হামলা ও হুমকির সংখ্যা বেড়েছে। সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশের অধীনে মামলা দেওয়া চালু রয়েছে।

 

জুলাই অভ্যুত্থান ও ৮ আগস্ট ২০২৪-এ অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ১,৪৩০ জন সাংবাদিকের ওপর আরও ১৫১টি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে।

 

এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাবে আছে

 

  1. ৩৮২ জন সাংবাদিকের ওপর ৭১টি হামলার ঘটনা
  2. ৪১টি মামলা, যার মাধ্যমে ৪০৬ সাংবাদিক আইনি হয়রানির শিকার
  3. ৫ জন সাংবাদিক নিহত
  4. নারী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে লিঙ্গভিত্তিক ১২টি হুমকি ও ৪টি হামলা
  5. অন্তত ১২টি গণমাধ্যমে তল্লাসীর নামে হয়রানি


সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। এক ঘটনায় ২৮ জন সাংবাদিককে 'গণহত্যায়' সহায়তার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। কিছু মামলায় অভিযোগকারীরা অভিযুক্তদের চিনতেন না, অন্যের প্রস্তুতকৃত কাগজে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন বা প্ররোচিত হয়েছিলেন।

 

গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর পরিকল্পিত হামলা

 

৫ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে বহু সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন, অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান জোরপূর্বক দখলে নেওয়া হয়েছে। ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার, বাংলাদেশ- সাংবাদিকদের জোরপূর্বক চাকরিচ্যুতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে।

 

২২ আগস্ট ২০২৪-এ, আদালত প্রাঙ্গণে একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিক শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রূপার ওপর হামলা হয়। রূপার মাথায় আঘাত করা হয় এবং উপস্থিত আইনজীবীরা অপমানসূচক স্লোগান দেন। সরকারদলীয় উপদেষ্টা একটি বৈঠকে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে ‘জাতীয় স্থিতিশীলতার হুমকি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে গণমাধ্যম স্বাধীনতা সীমিত করার পক্ষে মত দেন।

 

তথ্য উপদেষ্টা বলেন, যারা আগের স্বৈরাচারকে বৈধতা দিয়েছিল, তারা ‘গণহত্যা উসকে’ দিয়েছেন—তাদের কেউ পেশার দোহাই দিয়ে রেহাই পাবেন না। প্রেস সচিবও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার ও রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ তোলেন।

 

নারী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ঘৃণার ভাষা

 

নারী সাংবাদিকরা অনলাইনে হয়রানি, শারীরিক আক্রমণের হুমকি ও অপপ্রচারের শিকার হচ্ছেন। মতবিরোধী সাংবাদিকদের পেশাগত ও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে ঘৃণামূলক বক্তব্য ও অপচেষ্টা বাড়ছে।

 

নির্বাচনী স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ

 

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট কারচুপি, ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার অভিযোগ রয়েছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময় গুম, আটক ও ভুল তথ্য ছড়ানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হওয়ায় জনগণের আস্থা ক্ষীণ হয়েছে।

'হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি' জানায়, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারির মধ্যে ৭৫২টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে, যাতে ১৭ জন নিহত ও ২,৫০০ জন আহত হন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অন্তত ১২ জেলায় হামলা হয়।

নারী, তরুণ, লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী, আদিবাসী ও প্রতিবন্ধীরা এখনও রাজনৈতিক অংশগ্রহণে বড় বাধার সম্মুখীন।

 

দায়মুক্তি ও জবাবদিহির অভাব

 

২০২৪ জুড়ে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমাজের ওপর সহিংসতা ও হামলার ঘটনার কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হয়নি। অপরাধীরা আইনের আওতামুক্ত রয়ে গেছে। ২০২৪-এর নভেম্বরে সরকার ‘মিডিয়া সংস্কার কমিশন’ গঠন করে, যা ২০২৫-এর মার্চে প্রতিবেদন দাখিল করে—যেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, জবাবদিহি এবং সাংবাদিক নিরাপত্তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ উঠে আসে।

 

সুপারিশসমূহ

 

বাংলাদেশের অবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতি বিবেচনায়, আমরা জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ এবং সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে আহ্বান জানাই:

 

১. বাংলাদেশ সরকার যেন ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইনসহ ডিজিটাল আইনের সংস্কার করে সেটিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে;

 

২. ২০২৪ সালে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও গণমাধ্যমের ওপর সহিংসতার ঘটনার নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্ত করা;

 

৩. সাংবাদিক, অধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজ নেতাদের বিরুদ্ধে নির্বিচার গ্রেপ্তার, আইনি হয়রানি ও ভীতিমূলক পদক্ষেপ বন্ধ করে ন্যায়বিচার ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা;

 

৪. একটি জাতীয় গণমাধ্যম স্বাধীনতা কমিশন গঠন করা, যার কাজ হবে স্বাধীনতা লঙ্ঘনে নজরদারি করা, হামলার তদন্ত ও সাংবাদিকদের সুরক্ষায় সুপারিশ প্রদান;

 

৫. নারী সাংবাদিক ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় লিঙ্গ-সংবেদনশীল নীতি, বৈষম্যবিরোধী পদক্ষেপ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ;

 

৬. রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নিরপেক্ষ তদন্ত, বিচার ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ;

 

৭. সরকার, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের অংশগ্রহণে অনলাইন-অফলাইন উভয়ক্ষেত্রে নাগরিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষায় বহুপক্ষীয় সংলাপ চালু করা;

 

৮. নারী, লিঙ্গ ও যৌন সংখ্যালঘু এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণে আইনি ও সামাজিক বাধা দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়া;

 

৯. বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বাধ্যবাধকতা পালনে আন্তর্জাতিকভাবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন দাখিল বজায় রাখা;

 

১০. রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও অস্থিরতার সময়ে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও পেশাগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

 

সমর্থনকারী ও স্বাক্ষরকারী সংগঠনসমূহ:

 

ARTICLE 19
Free Press Unlimited
Voices for Interactive Choice and Empowerment (VOICE)
Attma Shahajjo Karmasuchi (SHP)
Centre for Governance Studies (CGS)
Bangladesh Disabled Development Trust Development Society (DS)
Chandradip Development Society (CDS)
Samajik Unnayan Sangstha (SUS)
Report171.com
South Asia Center for Media in Development (SACMID)
Chayatal Bangladesh
Light House
Noboprobhaat Foundation
Sakaler Kagoj
SoMaSHTe
The Daily Matobad (Barishal)
Unite Theatre for Social Action (UTSA)
Dataful
Badabon Sangho
Switch Bangladesh Foundation
The Daily Nawroj
The Daily Probaha
Bikrampur Chita (Munshiganj)
Chinnomul Manob Kallayan Society (CMKS)
DHRUBA
Community Welfare Foundation (CWF)
ipnewsbd
Ajker Arban
ABALAMBAN
BetterStories Limited

সব খবর