পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি বেদখল ও বহিরাগত সেটলার পুনর্বাসনের বিস্তারিত তালিকা প্রকাশের দাবি উঠেছে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায়। “পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে ভূমি কমিশন সক্রিয়করণ” শীর্ষক এ সভার আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির শফিকুল কবির মিলনায়তনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী। সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আন্দোলনের আরেক যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন।
ভূমি বেদখল পাহাড়ের সবচেয়ে বড় সংকট
জাকির হোসেন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার মূল ইস্যু ভূমি। পাহাড়ে আবাদযোগ্য জমি এমনিতেই সীমিত। অথচ ১৯৭৯ সাল থেকে সমতল জেলা থেকে চার লাখেরও বেশি বহিরাগতকে সেখানে বসানো হয়েছে। তারা জুম্ম জনগোষ্ঠীর দখলীয় ও রেকর্ডীয় জমিতে বসতি স্থাপন করে। নানা ষড়যন্ত্রমূলক প্রক্রিয়ায় স্থানীয়দের উচ্ছেদ করে জমি দখল করা হয়। এতে প্রচলিত আইন ও প্রথা লঙ্ঘন হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটানো হয়েছে। ভূমি সমস্যা সমাধানে ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়ন, কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ, পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ এবং জনগণকে আইনি ধারণা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
বৈষম্য দূরীকরণ আন্দোলনের দাবি
সভায় বেসরকারি উন্নয়নকর্মী শামসুল হুদা বলেন, জুলাই আন্দোলনের অন্যতম স্লোগান ছিল বৈষম্য দূরীকরণ। অথচ পাহাড়ের মানুষের জমির অধিকার রক্ষায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। ভূমি কমিশন নিয়ে বারবার নাটক হয়েছে, কার্যকর হয়নি কোনো উদ্যোগ। সরকার বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সেটলারদের পুনর্বাসনের প্রস্তাব
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক বজলুল রশীদ ফিরোজ বলেন, পাহাড়ে যে বাঙালি সেটলারদের বসানো হয়েছে, তাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নেওয়া হয়েছিল। এখন প্রয়োজন তাদেরকে পাহাড়ের বাইরে সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ। তিনি অভিযোগ করেন, বর্তমান সরকারও এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
রাজনৈতিক সমঝোতার প্রয়োজন
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ভূমি সমস্যা সমাধান ছাড়া পাহাড়ের অন্য সমস্যার অগ্রগতি সম্ভব নয়। শুধু আইন বা বিধিমালা করলেই সমাধান হবে না; প্রয়োজন রাজনৈতিক সমঝোতা। সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের সম্মতি ছাড়া এ সমস্যা মীমাংসা সম্ভব নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সামরিকায়ন ও দমননীতির অভিযোগ
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এক বছরে পাহাড়ে সামরিকায়ন বেড়েছে। নারীর ওপর সহিংসতা ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়েছে। সংবাদমাধ্যমে সেসব তথ্য প্রকাশ পায় না। তার মতে, সেটলারদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে আগামী দুই দশকে পাহাড়ীরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে।
সরকারের উদাসীনতা
বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, সরকারের গাফিলতির কারণেই সমস্যা প্রকট আকার নিয়েছে। পাহাড়ে কত জমি বেদখল হলো, কত সেটলার বসানো হলো, কোন সরকারের আমলে কত লিজ দেওয়া হলো—এসব তথ্য প্রকাশ করা হোক।
দুর্বল ভূমি কমিশন
গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী অভিযোগ করেন, ভূমি কমিশনে অদক্ষ ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যারা পাহাড়ে গিয়ে কাজই করেন না। তিনি বলেন, অনেক তথাকথিত “ভূমিহীন” সেটলার ইতোমধ্যেই বড় জমির মালিক। অথচ পাহাড়ীদের জমি ফেরত দেওয়া হচ্ছে না।
রাজনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া সমাধান নেই
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকট কোনো বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়, এটি রাজনৈতিক সমস্যা। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই সংকট সমাধানে যদি সরকার এগিয়ে না আসে, তবে ভবিষ্যতে আরও বড় সংকট তৈরি হবে। তাই তিনি রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানান।