রাজশাহীর মিনারুল ইসলাম স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেছেন। চিরকুটে লিখে গেছেন—“এই মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।” কিন্তু একইসঙ্গে জানিয়ে গেছেন, তারা মরতে বাধ্য হয়েছেন “ঋণের দায়ে আর খাবারের অভাবে।” সপ্তাহে ২,৭০০ টাকার কিস্তির চাপ, বর্ষায় কাজ না থাকা, চেয়ে খাওয়ার গ্লানি—সব মিলিয়ে মিনারুলের জীবনে বেঁচে থাকার চেয়ে মরাই সহজ হয়ে উঠেছিল।
একইদিন শরীয়তপুরে ঢাকাগামী একটি অ্যাম্বুলেন্সে থাকা মুমূর্ষু নবজাতককে দেড় ঘণ্টা আটকে রাখে স্থানীয় অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট। নবজাতকটি মারা যায় গাড়ির ভেতরেই। অভিযোগ, বাইরের গাড়ি রোগী নিতে এলে সিন্ডিকেটকে চাঁদা দিতে হয়। না দিলে বাধা, এমনকি প্রাণহানিও ঘটে।
এই দুই ঘটনা যেন বাংলাদেশের মৃত্যুর বহুমাত্রিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। আত্মহত্যা, চিকিৎসা বঞ্চনা, সড়ক দুর্ঘটনা, মব-সহিংসতা—সবই যেন এখন নিত্যদিনের খবর।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন এইচআরএসএস-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশে মব-সহিংসতা ও গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১৭৩টি। এতে নিহত হয়েছেন ৭৯ জন, আহত হয়েছেন ১৫৮ জন। আরও বিশদ তথ্য পাওয়া যাবে এই প্রতিবেদনে।
৯ আগস্ট রংপুরের তারাগঞ্জে ভ্যানচোর সন্দেহে দুই নিরপরাধ মানুষ—রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও ‘মবের ভয়ে’ হস্তক্ষেপ করেনি। পরে সেনাবাহিনীর সহায়তায় উদ্ধার করা হলেও দুজনই মারা যান।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১,৯৩০টি। শুধু জুন মাসেই খুন হয়েছেন ৩৪৩ জন।
সড়কপথেও মৃত্যুর মিছিল থেমে নেই। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, গত জুলাইয়ে সড়ক, রেল ও নৌপথে ৫৫৪টি দুর্ঘটনায় ৫৬৮ জন নিহত ও ১,৪১১ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে সড়কপথেই প্রাণ হারিয়েছেন ৫২০ জন।
জুলাই মাসে ঢাকার মাইলস্টোন স্কুলের সামনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিশুরা আগুনে পুড়ে মারা যায়। একই মাসে গাজীপুরে নালায় পড়ে নিখোঁজ হন ফারিয়া তাসনিম জ্যোতি। ৩৬ ঘণ্টা পর তার মরদেহ উদ্ধার হয়। এতিম হয়ে যায় তার যমজ সন্তান।
এইসব মৃত্যুর দায় কে নেবে? মিনারুল আত্মহত্যার আগে চিরকুটে দায়মুক্তি দিয়ে গেছেন। কিন্তু নবজাতক, রূপলাল, প্রদীপ, জ্যোতি কিংবা সড়কে প্রাণ হারানো মানুষদের দায় কি রাষ্ট্র নেবে?
এ দেশে মৃত্যু আসে ইট পড়ে, ভবন ধসে, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে, রাজনীতির গুলিতে, কিংবা আগুনে পুড়ে। পাহাড় ধস, ট্রলারডুবি, চিকিৎসা বঞ্চনা—সবই যেন মৃত্যুর স্বাভাবিক পথ।
২০২৪ সালের রক্তক্ষয়ী জুলাইয়ে যে ‘নতুন ব্যবস্থার’ স্বপ্নে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল, এক বছর পর সেই স্বপ্ন কি মুখ থুবড়ে পড়েছে?
এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ড কি সত্যিই মৃত্যু উপত্যকা হয়ে থাকবে? নাকি সময় এসেছে প্রতিটি মৃত্যুর দায় রাষ্ট্র, সমাজ ও আমাদের সবার কাঁধে তুলে নেওয়ার?