দীর্ঘদিন ধরে ভারসাম্যহীন অবস্থায় থাকা বাংলাদেশ-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানের সাম্প্রতিক ঢাকা সফরকে ঘিরে। চার দিনের এই সফরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, শিল্প, খাদ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা নিয়ে একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান, খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন পাকিস্তানের প্রতিনিধি দল। আলোচনায় উঠে আসে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি, শুল্ক জটিলতা, পণ্য পরিবহন সমস্যা এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব।
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি হয় তুলনামূলকভাবে কম, অথচ পাকিস্তান থেকে আমদানি হয় বেশি। পরিসংখ্যানের হিসেবে পাকিস্তান থেকে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের অধিক আমদানির বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি মাত্র ৫৮ মিলিয়ন ডলার। এই অসম বাণিজ্য ভারসাম্য বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের শাসনামলে রাজনৈতিক দূরত্বের কারণে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থবির হয়ে পড়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই ধারাবাহিকতা বজায় না থাকায়, পাকিস্তানি মন্ত্রীর এই সফর নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বৈঠকে উভয় পক্ষই কৃষি পণ্য, ওষুধ, তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক ও হালকা প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি-বিনিময় বাড়ানোর বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (SAFTA) কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়, যাতে শুল্ক বাধা কমিয়ে আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়ানো যায়।
তবে রাজনৈতিক বাস্তবতা ও অতীত অভিজ্ঞতা অনেককে সতর্ক করে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কূটনৈতিক সম্পর্কের জটিলতা, নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং আস্থার অভাব এই উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা চান, পাকিস্তানের বাজারে প্রবেশে যেন কোনো ধরনের বৈষম্য না থাকে এবং পণ্য পরিবহনে সহজতর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “আমরা চাই পারস্পরিক সম্মান ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে একটি টেকসই বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে উঠুক। রাজনৈতিক মতপার্থক্য যেন অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বাধা না দেয়।”
যদিও বাংলাদেশ–পাকিস্তান বাণিজ্য সম্পর্ককে ‘খুব বড় সম্ভাবনাময়’ মনে করছেন না অর্থনীতিবিদ ড. গোলাম মোয়াজ্জেম। বরং দুই দেশের রপ্তানি পণ্যের ধরন কাছাকাছি হওয়ায় এটি বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও তিনি মনে করেন।
“পাকিস্তানও গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, প্রসেসড ফুড উৎপাদন করে। কাছাকাছি পণ্য হওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানির সম্ভাবনা সীমিত,” বলেন মি. মোয়াজ্জেম।
এই সফরকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারের আলোচনা শুরু হলেও, বাস্তবায়নের পথে রয়েছে বহু চ্যালেঞ্জ। তাই প্রশ্ন থেকেই যায়—পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর চিন্তা কতটা কাজে দেবে, আর কতটা থেকে যাবে কূটনৈতিক সৌজন্যের গণ্ডিতে?