বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহে আপাত স্বস্তি দেখা দিলেও, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ধারাবাহিক পতন শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানে অস্থিরতা তৈরি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ও এলসি নিষ্পত্তি উভয়ই ২৫ শতাংশের বেশি কমেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, যন্ত্রপাতি আমদানির এই ধস নতুন বিনিয়োগে উদ্যোক্তাদের অনাগ্রহের প্রতিফলন। সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “এই প্রবণতা শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদি মন্দার ইঙ্গিত দেয়, যা কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
খাতভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, গার্মেন্টস খাত ছাড়া অধিকাংশ শিল্পেই আমদানি কমেছে। বস্ত্র ও ওষুধশিল্পে যথাক্রমে ২৫.৬৮% ও ৩৫.২৭% হ্রাস পেয়েছে। চামড়াশিল্পে আমদানি বেড়েছে, তবে এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৪৪%। উদ্যোক্তারা বলছেন, এলসি খোলার কঠোর শর্ত ও নগদ মার্জিনের চাপ নতুন বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করছে।
কাঁচামাল আমদানিতে দ্বৈত চিত্র দেখা যাচ্ছে। রফতানিমুখী শিল্পে কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ১৮.৬২%, কিন্তু অভ্যন্তরীণ চাহিদানির্ভর খাতে—যেমন ভোজ্যতেল, তুলা, ওষুধ ও ইস্পাতে—পতন লক্ষ্য করা গেছে।
মুদ্রানীতির দিক থেকে দেখা যাচ্ছে, টানা চার বছর ধরে সংকোচনমূলক নীতি, উচ্চ সুদ ও ডলার সংকট বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে। মে মাসে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৭.১৫%, জুনে তা নেমে এসেছে ৬.৪৯%-এ, যা সাম্প্রতিক সময়ের সর্বনিম্ন।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিশেষ করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের সরকার পরিবর্তনের পর, বিনিয়োগ পরিবেশ আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নীতি সহায়তা, ইউটিলিটি সংকট ও প্রশাসনিক জটিলতা বিনিয়োগে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সতর্ক করে বলেন, “চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত আপাত স্বস্তিদায়ক হলেও এর পেছনে আমদানি হ্রাসের নেতিবাচক কারণ রয়েছে। বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত না হলে এই ভারসাম্য টিকবে না”।
সব মিলিয়ে, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির পতন, বিনিয়োগ স্থবিরতা ও কর্মসংস্থান সংকট বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নীতিগত স্থিতিশীলতা, সুদের হার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংক খাতে সুশাসন ছাড়া এই সংকট কাটানো সম্ভব নয়।