কাবুলে তালেবান শাসনের চার বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সেনা প্রত্যাহারের পর দ্রুত কাবুল দখল করে গোষ্ঠীটি। চার বছর পর আফগানিস্তান ভুগছে ব্যাপক মানবিক সংকট, নারী অধিকার হরণ, আন্তর্জাতিক নিঃসঙ্গতা ও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অস্থিরতায়।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও ভূরাজনীতি
২০২৪ সালে রাশিয়া প্রথম দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ফলে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা আংশিকভাবে পূরণ করছে রাশিয়া ও চীন। যদিও বেইজিং এখনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, তবে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এ বছরের শুরুতে তালেবান রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র গ্রহণ করেন, যা কার্যত এক ধরনের কূটনৈতিক স্বীকৃতি হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
এদিকে জার্মানি ও কিছু ইউরোপীয় দেশ কাবুলে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়ালেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ তালেবানকে বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অনিচ্ছুক।
ব্যাপক নির্বাসন ও শরণার্থী সংকট
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে ইরান ও পাকিস্তান থেকে ২১ লাখের বেশি আফগানকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। এর বাইরেও জার্মানি আফগানিস্তানে অপরাধে দণ্ডিত অন্তত ১০৯ জনকে ফেরত পাঠিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই প্রত্যাবাসনকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে নিন্দা জানিয়েছে।
নারী অধিকারঃ সবচেয়ে বড় ক্ষত
তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকেই নারী অধিকার কার্যত বিলুপ্ত হয়েছে। ১২ বছরের বেশি বয়সি প্রায় ১৪ লাখ মেয়েকে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানও নারীদের জন্য বন্ধ। ২০২২ সাল থেকে নারীদের পার্ক, ক্রীড়াঙ্গন ও জনসমাগমস্থলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
গত শুক্রবার ক্ষমতা দখলের চার বছর পূর্তি উপলক্ষে কাবুলে ‘ফ্লাওয়ার শাওয়ার’ উৎসবে হাজারো পুরুষ সমবেত হলেও সেখানে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। একই দিনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় তাখার প্রদেশে “ইউনাইটেড আফগান উইমেনস মুভমেন্ট ফর ফ্রিডম” নামের সংগঠনটি ঘরে বসে প্রতিবাদ জানায়। তারা জানায়, ১৫ আগস্ট আফগান নারীদের জন্য ‘একটি কালো দিন’, যা তাদের কাজ, শিক্ষা ও সামাজিক জীবন থেকে নির্বাসনের সূচনা করে।
মানবিক সংকটঃ অর্ধেক জনগণ সাহায্যনির্ভর
ইইউ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তানের প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ—যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক—বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে, প্রতি চারজন আফগানের একজন মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, আর প্রতি তিনজন শিশুর একজন অপুষ্টিতে আক্রান্ত।
মানবিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে আন্তর্জাতিক সাহায্য হ্রাস। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ইউএসএআইডির কার্যক্রম স্থগিত করায় প্রায় ৩০ লাখ মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং ৪২০টি ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রতিবেশী দেশ থেকে বহিষ্কৃত লাখো শরণার্থীর চাপ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পদক্ষেপ
গত মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) তালেবান নেতা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা ও প্রধান বিচারপতি আবদুল হাকিম হাক্কানির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। অভিযোগ—নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর সংগঠিত নিপীড়ন, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা, চলাফেরা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ—যা ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’।
তালেবান নেতৃত্বের বক্তব্য
তবে তালেবান নেতা আখুন্দজাদা দাবি করেছেন, শারিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আফগানিস্তান দুর্নীতি, মাদক, ডাকাতি ও অবিচার থেকে মুক্ত হয়েছে। তিনি জনগণকে সতর্ক করে বলেছেন, আল্লাহর দেয়া এই ‘বরকতের’ জন্য অকৃতজ্ঞ হলে কঠিন শাস্তি নেমে আসবে।
চার বছরের শাসনে তালেবান নিজেদের ক্ষমতা সুসংহত করেছে। তবে তার বিনিময়ে আফগান জনগণ হারিয়েছে মৌলিক অধিকার, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং স্বাভাবিক জীবনের নিরাপত্তা। বিশেষ করে নারীরা শিক্ষা ও জনজীবন থেকে সম্পূর্ণ নির্বাসিত। আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে তালেবান সরকার এখনও বড় প্রশ্নবিদ্ধ, আর দেশটি মানবিক সহায়তা ছাড়া টিকে থাকতে অক্ষম।