জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল ইউএনএফপিএ-এর মতে বাংলাদেশে বর্তমানে বাল্যবিয়ে কমার গতি অত্যন্ত ধীর হওয়ায় এই প্রথা পুরোপুরি নির্মূল হতে দুইশো বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে। এ বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) “আমার দিন, আমার অধিকার” প্রতিপাদ্যে পালিত হল বিশ্ব শিশু দিবস। বিশ্বের লাখো কন্যাশিশু এখনও নিরাপত্তা, শিক্ষা ও নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত—এই প্রতিপাদ্য সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়।
বিবিএসের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) ২০২৫-এর প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী, ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ১৮ বছরের আগেই বিয়ের হার ২০১৯ সালের ৫১.৪ শতাংশ থেকে কমে ৪৭.২ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু উদ্বেগজনক হলো ১৫-১৯ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে বিবাহিত হওয়ার হার, যা ২০১৯ সালে ছিল ৩২.৯ শতাংশ এবং ২০২৫ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮.৯ শতাংশে। এই বৈপরীত্য দেখায়—আগের প্রজন্মের তুলনায় মোট হার কমলেও বর্তমান কিশোরীদের মধ্যে বাল্যবিয়ে বাড়ছে।
জরিপে দেখা যায়, বাল্যবিয়ে কমার গতি বছরে মাত্র ২.১ শতাংশ। এই হারে চললে প্রথা দ্রুত উত্পাটিত হবে না। এমআইসিএস একই সঙ্গে জানিয়েছে, শিশু মৃত্যু ও মাতৃস্বাস্থ্যের কিছু সূচকে উন্নতি হয়েছে; হাসপাতালে প্রসব ও দক্ষ সহায়তা পাওয়া বেড়েছে। তবে পরিবার পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবার দুর্বলতা কিশোরীদের অল্প বয়সে গর্ভধারণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং কিশোরী মাতৃত্বের হার (এবিআর) ৮৩ থেকে বেড়ে ৯২ হয়েছে, প্রতি এক হাজার ১৫-১৯ বছর বয়সী মেয়ের মধ্যে কিশোরী মাতৃত্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য, মানবাধিকার ও উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনএফপিএ ও ইউনিসেফের সতর্কবার্তা স্পষ্ট—মেয়েদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত না করলে বাংলাদেশ ২০৩১ সালের উচ্চ-মধ্যম আয় ও এসডিজি লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হতে পারে। ইউএনএফপিএ প্রতিনিধি ক্যাথরিন ব্রিন কামকং এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বিনিয়োগ ছাড়া লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। ইউনিসেফের রানা ফ্লাওয়ার্স সতর্ক করেন, বাল্যবিয়ে শিশু ও নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার এক রূপ এবং এটি জাতীয় উন্নয়নের পথে বড় ব্যাধি।
স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন, অল্প বয়সে গর্ভধারণ শারীরিক ও মানসিক জটিলতা বাড়ায়; রক্তশূন্যতা, প্রি-এক্লাম্পসিয়া, প্রসব জটিলতা ও নবজাতকের কম ওজনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। সামাজিকভাবে পড়াশোনা বন্ধ হওয়া, মানসিক বিপর্যয় ও আত্মনির্ভরতার অভাব কিশোরীদের ভবিষ্যৎ সঙ্কুচিত করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্যনিবারণ, মেয়েদের বৃত্তিমূলক শিক্ষায় সুযোগ সৃষ্টি, স্থানীয় নেতৃত্বের ভুমিকা বদলানো এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবার সম্প্রসারণ জরুরি। সংগঠনগুলোকে পরিবার পরিকল্পনা সেবা পৌঁছে দিতে এবং স্কুলে যৌনশিক্ষা ও অধিকার পাঠক্রম চালু করতে হবে।
নাগরিক সমাজ, ধর্মীয় নেতা ও স্থানীয় প্রশাসন একযোগে কাজ করলে দ্রুত ফল পাওয়া সম্ভব—এমনটাই বিশ্লেষকরা মনে করেন। পাশাপাশি তথ্যভিত্তিক মনিটরিং ও সময়োপযোগী নীতি প্রয়োগ জরুরি। সমাজের সকল স্তরে সমন্বিত যত্ন ছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা ও সম্ভাবনা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।