লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন- এই শব্দগুলো এখন আর নিয়মিত শোনা যায় না এফডিসির চার দেয়ালের ভেতর। শুটিং ফ্লোর ও ডাবিং স্টুডিওতে নেই আগের সেই ব্যস্ততা। নেই শুটিং লাইটের ঝলকানি, নেই তারকাদের সরব উপস্থিতি। দীর্ঘদিন ধরেই কার্যত স্থবির অবস্থায় আছে ঢাকাই সিনেমার আঁতুরঘর খ্যাত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন, বিএফডিসি।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও বড় অস্বস্তি। ২০২২ সালে শুরু হওয়া বিএফডিসি কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্প নির্ধারিত সময় পার হলেও এখনো শেষ হয়নি। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালের জুনে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশের মতো। ফলে শিগগিরই এই কমপ্লেক্স চালু হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। এসব কারণেই কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চলচ্চিত্রকারদের অনেকেই এফডিসিকে এখন ‘ভূতুড়ে বাড়ি’ বলে উল্লেখ করছেন।
১৯৫৭ সালে যাত্রা শুরু করা এফডিসি একসময় ছিল দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে এবং আধুনিকায়নের অভাবে প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে কার্যকারিতা হারিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সিনেমার উন্নয়নের চেয়ে বিভিন্ন প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রমেই এখানে বেশি সময় ব্যয় হয়েছে।
সরকারি নথি অনুযায়ী, বিএফডিসি কমপ্লেক্স প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩২৩ কোটি টাকা। সর্বশেষ সংশোধনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬৫ কোটি টাকায়। প্রকল্পের মেয়াদও বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। তবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ প্রকল্পের অগ্রগতিকে সন্তোষজনক নয় বলে উল্লেখ করেছে।
এদিকে আর্থিক সংকটও পিছু ছাড়ছে না এফডিসির। হিসাব বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত এক দশকে সরকার থেকে অনুদান ও ঋণ মিলিয়ে প্রায় ৮০ কোটি টাকা নিতে হয়েছে সংস্থাটিকে। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তিগত দিক থেকেও পিছিয়ে আছে এফডিসি। বর্তমানে হাতে থাকা বেশিরভাগ ক্যামেরা ও সাউন্ড সরঞ্জাম পুরোনো ও অচল। আধুনিক শুটিং, ডাবিং কিংবা পোস্ট-প্রোডাকশনের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না থাকায় নির্মাতারা বাইরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই কাজ করাচ্ছেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পুরো এফডিসিতে গতকাল শুটিং চলছিল মাত্র একটি চলচ্চিত্রের। অন্য ফ্লোরগুলো ছিল প্রায় ফাঁকা। চলচ্চিত্রকারদের ভাষ্য, নিয়মিত কাজ না থাকায় এখানে দিনের পর দিন নীরবতা বিরাজ করে।
এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুমা রহমান তানি বলছেন, সীমিত সম্পদ নিয়েও আয় বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। শুটিং ও ডাবিং ফ্লোরের ভাড়া কমানো হয়েছে, নিয়ম সহজ করা হয়েছে। তাঁর দাবি, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি যুক্ত করা গেলে এফডিসিকে আবারও লাভজনক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
তবে বাস্তবতা বলছে, অবকাঠামোগত দুরবস্থা, আর্থিক ঘাটতি ও দীর্ঘসূত্রতা মিলিয়ে এফডিসি এখন এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ঢাকাই সিনেমার এই ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান আবার প্রাণ ফিরে পাবে কি না, সে প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার মনে।