এ দেশের প্রথম লোককাহিনিনির্ভর পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘রূপবান’ মুক্তির ৬০ বছর পূর্ণ হল ৫ নভেম্বরে। ১৯৬৫ সালের ৫ নভেম্বর সারা বাংলায় মুক্তি পায় সালাহউদ্দিন পরিচালিত এই ঐতিহাসিক ছবি। অভিনয়ে ছিলেন সুজাতা, আনোয়ার হোসেন, চন্দনা, সুভাষ দত্তসহ আরও অনেকে। উর্দুভাষী ছবির দাপটের সময় যখন বাংলা ছবি টিকেই থাকা কঠিন হয়ে পড়েছিল, তখন ‘রূপবান’ বাংলা সিনেমাকে বাণিজ্যিক সাফল্য তো দিলই, সঙ্গে নতুন সাংস্কৃতিক ধারাও তৈরি করে।
যাত্রামঞ্চ থেকে সিনেমার পর্দা
বাংলা সিনেমায় সালাহউদ্দিনের যাত্রা শুরু ১৯৬১ সালে ‘যে নদী মরুপথে’ দিয়ে। এরপর নির্মাণ করেন ‘সূর্যস্নান’ ও ‘ধারাপাত’। ‘ধারাপাত’ সমালোচকদের প্রশংসা পেলেও বক্স অফিস ব্যর্থতায় জীবিকার তাগিদে তাঁকে তথ্যচিত্র নির্মাণে মন দিতে হয়। কিন্তু বাংলা দর্শককে হলে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন ছাড়েননি তিনি।
সে সময় দেশে উর্দু ছবির প্রভাব ছিল ব্যাপক। বাংলা ভাষার দর্শক কমতে থাকায় কাহিনি খুঁজতে তিনি নজর দেন জনপ্রিয় যাত্রাপালা ‘রূপবান’-এর দিকে। তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব মফস্বলে এই যাত্রাপালা সাংস্কৃতিক ঝড় তুলেছিল। সালাহউদ্দিন এক রাত বসে পুরো পালাটি দেখে ফেরেন অনুপ্রাণিত হয়ে যে লোকজ রূপ, গান আর নাটকীয়তা দিয়ে দর্শককে হলে ফিরিয়ে আনা সম্ভব, এই বিশ্বাস নিয়েই শুরু হয় চলচ্চিত্রের কাজ।
কিন্তু ‘রূপবান’ নির্মাণের পরিকল্পনা প্রথম করেছিলেন দেশের প্রথম চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা ‘সিনেমা’–র সম্পাদক ও চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ফজলুল হক। তিনি কিছু গান ও দৃশ্যও ধারণ করেছিলেন রমনা পার্কে। নানা সমস্যায় তাঁর কাজ থেমে যায়। পরবর্তীতে তাঁর অনুমতিতেই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ শুরু করেন সালাহউদ্দিন।
তখনকার চলচ্চিত্রসমাজের বড় অংশই বিশ্বাসই করেননি যাত্রাপালা থেকে সফল ছবি তৈরি সম্ভব! কিন্তু সালাহউদ্দিন থামেননি। দুই বছর পরিশ্রমের পর ১৯৬৫ সালের শেষভাগে ‘রূপবান’ মুক্তি পায় আর তারপরের ইতিহাস কিংবদন্তি।
রেকর্ড সৃষ্টি
মুক্তির পর সারা বাংলায় ‘রূপবান’ তৈরি করে বিস্ময়। বাংলাভাষী দর্শক হলে ভিড় জমাতে শুরু করেন, উর্দু ছবির বাজার মারাত্মকভাবে কমতে থাকে।
বাংলাদেশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সফল লোককাহিনিনির্ভর চলচ্চিত্র হিসেবে ‘রূপবান’ তৈরি করে নতুন ধারা। দেশের বড় বড় সিনেমা হলে টানা বছর ধরে চলেছে এ ছবি। এমনকি পাকিস্তান আমলেও বাংলা সিনেমা নির্মাণের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয় এই ছবির সাফল্য।
এই চলচ্চিত্রেই প্রথম বড় পরিসরে লোকসংগীত, নাচ এবং নাট্যধর্মী উপস্থাপন সিনেমার দর্শকপ্রিয় বিনোদনে পরিণত হয়।
‘রূপবান’ কন্যা সুজাতা
নায়িকা সুজাতা এ ছবিতেই রূপবানের চরিত্রে অভিনয় করে সারা দেশে পরিচিত হন ‘রূপবান কন্যা’ নামে। তাঁর ভাষায়,
এখনও মানুষ আমাকে ‘রূপবান’ বলে ডাকেন। এক জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!
তিনি জানান, প্রথমে ফজলুল হক নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও পরে কাজ স্থগিত হয়। সালাহউদ্দিন নতুন করে প্রস্তাব দিলে তিনি শর্ত দেন ফজলুল হকের অনুমতি পেলে তবেই করবেন। অনুমতি পাওয়ার পর শুরু হয় অসাধারণ এক যাত্রা।
সাফল্যের পরেও যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি এ নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে সুজাতার মনে। তিনি বলেন,
রূপবান’ই দেশে উর্দু ছবির দাপট ভেঙেছিল। ফোক চলচ্চিত্র হিসেবে এটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটায়। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মূল্যায়ন হয়নি যে পরিমাণ হওয়া দরকার ছিল।
৬০ বছর পরও ‘রূপবান’ শুধু একটি সিনেমার নাম নয় বরং বাংলা ভাষা, লোকসংস্কৃতি ও দেশীয় শিল্পচর্চার পুনর্জাগরণের ইতিহাস।