সর্বশেষ

সম্পাদকীয়

গ্যাস সংকটে শিল্পে স্থবিরতাঃ সংকট সমাধানের উদ্যোগে অনীহা

প্রকাশিত: ২৫ অগাস্ট ২০২৫, ০১:২২
গ্যাস সংকটে শিল্পে স্থবিরতাঃ সংকট সমাধানের উদ্যোগে অনীহা

গত বছরের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর এখনও পর্যন্ত দেশে যেমন স্থিতিশীলতা আসেনি, তেমনই দেশের অর্থনীতি বহুমাত্রিক সমস্যায় জর্জরিত। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ নেই চলে, চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বেহাল দশা। এমনকি অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগও অনুল্লেখযোগ্য। অর্থাৎ, দেশের ভেতরেও নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করছে না। অন্যভাবে বললে, দেশে বিনিয়োগের জন্য যথাযথ পরিবেশ নেই। যাদের বিনিয়োগ ছিল, তারাও নানা দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। অনেক বিনিয়োগকারী গোপনে মূলধন সরিয়ে নিচ্ছেন। যেসব শিল্প-কারখানা আছে, সেগুলোও নানামাত্রিক চাপে রয়েছে। এর সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে তীব্র গ্যাস সংকট।

 

গত ২১ আগস্ট বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, পোশাক শিল্পে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না পাওয়া এবং পর্যাপ্ত চাপ বজায় না থাকায় অনেক কারখানা পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন চালাতে পারছে না। ফলে রপ্তানি ও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এদিকে বর্তমান ড. ইউনূস প্রশাসন এ বিষয়ে কোনো তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি; উপরন্তু আগের সরকারের নেওয়া বেশ কয়েকটি উদ্যোগ বাতিল করেছে।

 

নিজস্ব খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান বা উত্তোলন বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এমনকি আমদানি করতে হলেও যে ধরনের অবকাঠামো প্রয়োজন, তা নির্মাণও সময়সাপেক্ষ। আগামী ২–৩ বছরের মধ্যে গ্যাস সমস্যার সমাধান করতে হলে পূর্বের সরকারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে কিংবা এখনই নতুন উদ্যোগ নিতে হবে।

 

বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৩,৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট, কিন্তু সরবরাহ করা যাচ্ছে মাত্র ২,৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটের সামান্য বেশি। ২০২৪ সালেও দেশে গ্যাস সরবরাহ ছিল দৈনিক ৩,১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে ক্রমাগতভাবে গ্যাস সরবরাহ কমছে।

 

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৬টি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছিল—সুন্দলপুর, শ্রীকাইল, রূপগঞ্জ, ভোলা উত্তর, জকিগঞ্জ ও ইলিশা। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত সময়কালে ১৫৫টি কূপ খনন করা হয়েছিল। অনশোরে দেশীয় কোম্পানি বাপেক্স, বিজিএফসিএল ও এসজিএফএল-এর অধীনে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ (অনুসন্ধান, উন্নয়ন/মূল্যায়ন, কূপের ওয়ার্কওভার) খননের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে ৭টি প্রকল্পের আওতায় ১৬টি কূপ খনন কাজ চলমান ছিল।

 

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জ্বালানী বিভাগ ২০২৫–২০২৮ সময়ে অনশোরে দেশীয় কোম্পানি বাপেক্স, বিজিএফসিএল ও এসজিএফএল-এর অধীনে ৬৯টি কূপ খনন ও ৩১টি ওয়ার্কওভার কার্যক্রমের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। সেসব কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার কার্যক্রম শেষ হলে আনুমানিক ৯৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সংযোজন ও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সমন্বয় করা সম্ভব হবে বলেও সেই সময়ের প্রক্ষেপণে উল্লেখ ছিল। কিন্তু গত এক বছরে এসব উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে পেট্রোবাংলা বা জ্বালানি বিভাগকে উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি। তাই গ্যাস সংকট ২০৩০ সাল পর্যন্ত বা তারও বেশি সময় ধরে চলতে থাকবে বলে আশঙ্কা করা যায়।

 

দেশীয় গ্যাস উৎপাদন যেহেতু বাড়ানো যাচ্ছে না, তাই এখন ভরসা করতে হচ্ছে আমদানি করা এলএনজির ওপর। দেশে ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি ও দেশীয় কোম্পানি সামিট লিমিটেডের দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে বর্তমানে আমদানি চলছে। সামিটের দ্বিতীয় এবং দেশের তৃতীয় এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের জন্য ২০২৩ সালে একটি চুক্তি হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৬ সালে সামিটের দ্বিতীয় এলএনজি টার্মিনাল বছরে ১৫ লাখ টন এলএনজি সরবরাহের কথা ছিল।

 

কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের পর গত বছরের অক্টোবরে সামিটের সেই চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। নতুন করে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করার উদ্যোগও ড. ইউনূস প্রশাসন নেয়নি। তীব্র গ্যাস সংকটে যদি আমদানি করে হলেও দেশীয় শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচাতে হয়, তবে সে পথও আপাতত বন্ধ।

 

একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, গ্যাস সংকট থেকে বাঁচতে হলে এবং দেশের শিল্প-কারখানা সচল রাখতে হলে এখনই কার্যকর উদ্যোগ ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে হবে।

সব খবর