কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের শতকরা ৭০ ভাগ রপ্তানী-আমদানি বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে থাকে। এবং সব মিলিয়ে দেশের সামগ্রিক বাণিজ্যের ৯২ ভাগই একরকম এই বন্দরকেই তত্ত্বাবধান করতে হয়। এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারত, নেপাল বা ভুটানের মত দেশগুলোও ট্রান্সশিপমেন্টের কাজে এই বন্দর অতীতে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করেছে। এই বন্দরের রয়েছে এমন এক নিবন্ধিত ইতিহাস যা প্রাচীন রোমান যুগ পর্যন্ত আমাদের টেনে নিয়ে যাবে।
অতি সম্প্রতি (১২ই অক্টোবর) বাংলাদেশ সরকারের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব একটি সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম বন্দরের তিনটি কন্টেইনার টার্মিনাল আসছে ডিসেম্বরের মধ্যে বিদেশী কোম্পানীদের লিজ বা ইজারা দেবেন বলে একটি সংবাদ প্রকাশিত হলে বাংলাদেশের বিভিন্ন বাংলা ও ইংরেজি, জাতীয় দৈনিকের পাশাপাশি নানা অন্তর্জাল দৈনিক ও এমনকি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম ও বিশেষত: বন্দর-সংক্রান্ত ওয়েব সাইটগুলোয় এই সংবাদটি খুবই গুরুত্বের সাথে উদ্ধৃত হয়। কেন চট্টগ্রাম বন্দর এত গুরুত্বপূর্ণ? এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব ছাড়াও এই বন্দরের আছে সহস্রাব্দ ব্যাপী দীর্ঘ এতই গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস যে এই বন্দর যেন ‘ইউনেস্কো’ যেমন একটি জাতির নানা কিছুকে ‘জাতীয় ঐতিহ্য’ বা ‘ন্যাশনাল হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষণা করে, এই বন্দরও তেমন একটি স্থান। এমনকি বিদ্যমান অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত যদি নানা আর্থিক-ব্যবসায়িক হিসেবে বাস্তবিকই বন্দরের জন্য ভাল বা ফলপ্রসূও হয়, তবু এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এই বন্দরের ইতিহাস সম্পর্কে একটু মনে হয় জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
প্রাচীন যুগ
বাঙালি হিসেবে আমরা নিজেরাই নিজেদের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সম্পদ সম্পর্কে এত কম জানি এবং সামগ্রিক আত্মমর্যাদাবোধ আমাদের এতই কম যে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান মানচিত্রগুলোতেও যে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরকে একটি ‘প্রাকৃতিক বন্দর’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, সে খবর আমরা রাখিই না। এমনকি গ্রিক বংশোদ্ভূত মিশরীয় ভূতত্ত্ব ও নক্ষত্রবিদ টলেমির মানচিত্রেও চট্টগ্রাম বন্দরের উল্লেখ আছে। হ্যাঁ, খ্রিষ্ট-পূর্ব দ্বিতীয় শতকে টলেমির মানচিত্রে চট্টগ্রাম বন্দরকে প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ বন্দরগুলোর অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। খ্রিষ্ট-পূর্ব চতুর্থ শতক থেকে এই বন্দর বঙ্গোপসাগরের ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দর হিসেবে টিঁকে আছে। চট্টগ্রাম নগরী এই বন্দরকে চারদিক থেকে পরিবেষ্টন করে আছে।
মধ্যযুগ থেকেই ভূ-মধ্যসাগরীয় দেশগুলোয় চট্টগ্রামের এই প্রাকৃতিক বন্দর কিন্তু সুপরিচিত ছিল। আরব নাবিকেরা দশম শতাব্দী থেকে এই বন্দরে আসা শুরু করে। পর্তুগীজ ও ভেনিশীয় পরিব্রাজকেরা এই বন্দরকে ‘পোর্টো গ্র্যান্ডে’ বা ‘মহা বন্দর’ হিসেবে অভিহিত করতো এবং ১৫৫২ সালে জোয়াও দ্যু বারোজ চট্টগ্রামকে উল্লেখ করেছেন বাংলা রাজ্যের বিখ্যাত ও সমৃদ্ধতম নগরী হিসেবে।
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এই মোহিনী, সমুদ্র নগরী গুপ্ত সাম্রাজ্য, গৌড় রাজ্য, পাল সাম্রাজ্য, চন্দ্র বংশ, সেন রাজ্য ও পূর্ব বাংলার দেব রাজ্যের শাসকগণ কর্তৃক অধিকৃত হয়েছে।
আদি-মধ্য যুগ
মূলত: নবম শতক থেকেই আরব মুসলিমদের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের সামুদ্রিক সম্পর্ক ও বাণিজ্য বিনিময় সূচীত হয়েছিল। ঐতিহাসিক মুহাম্মদ আল-ইদ্রিসির মতে, আনুমানিক ১১৫৪ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ইরাকের বসরা নগরীর সাথে চট্টগ্রামের একটি বিকাশমান জাহাজ চলাচল পথ গড়ে ওঠে এবং এভাবেই আব্বাসীয় যুগের রাজধানী শহর বসরার সাথে বাংলার সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল। মধ্যযুগের চট্টগ্রাম দেখতে দেখতে একটি সমৃদ্ধ বন্দর নগরী হিসেবে গড়ে উঠেছিল এবং তার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল চীন, সুমাত্রা, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া এবং এমনকি পূর্ব আফ্রিকা পর্যন্ত। মহাসাগরের পথ ধরে মুক্তা, রেশম, মসলিন, চাল, স্বর্ণমুদ্রা, অশ্ব এবং বারুদ পৃথিবীর নানা দেশে পৌঁছে দেওয়ার কাজে মধ্যযুগে তাই চট্টগ্রাম বন্দর প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
এমনকি স্বয়ং ইবনে বতুতা আমাদের এই সমুদ্র শহর পরিভ্রমণে ১৩৪৫ সালে এসেছিলেন। ভেনিসের নিকোলো ডি কন্টিও প্রায় বতুতার সময়েই এখানে এসেছিলেন। চৈনিক পরিব্রাজক ঝুয়ান জাং ও মা হুয়ানের ভ্রমণকাহিনীতেও চট্টগ্রাম বন্দরের উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিক এই বন্দরের জলপথে আরো বাণিজ্য ছিল আফ্রিকা, ইউরোপ, চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথেও। ১৫২৮ সালে সুলতান গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহ চট্টগ্রামে পর্তুগিজ বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন।
পর্তুগিজ যুগ
আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরে ষোড়শ শতকেই গোয়া এবং মালাক্কা থেকে পর্তুগিজ জাহাজগুলো আসা শুরু করে। এসময় সারা পৃথিবীতেই পর্তুগিজরা ক্রীতদাস ব্যবসা এবং জলদস্যুতায় অগ্রণী ছিল এবং ১৬০২ সালে তারা চট্টগ্রামের নিকটস্থ সন্দ্বীপ দখল করে। ১৬১৫ সালে পর্তুগিজ নৌবাহিনী চট্টগ্রামের উপকূলরেখায় ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং আরাকানী রণতরীর একটি সম্মিলিত বাহিনীকে পরাস্ত করে। যাহোক, ১৬৬৬ সালে মুঘল বিজয়ের পর চট্টগ্রাম বন্দরে পর্তুগিজদের ১৩০ বছর মেয়াদী আধিপত্যের অবসান হয়।
মোগল যুগ
আনুমানিক ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ন্ত্রণে আনার পর থেকে গোটা চট্টগ্রাম শহরকে নতুনভাবে সাজানোর নানা পরিকল্পনা নেয়। ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত এই নগরী এবং বন্দর বাংলার নবাবদের হাতে ছিল। তবে ১৭৯৩ সাল থেকে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’ অতীতের মোগল শাসনাধীন বাংলা প্রদেশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং চট্টগ্রাম বন্দরও তাদেরই করতলগত হয়।
বৃটিশ শাসন এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের আধুনিকায়ন
আজকের এই আধুনিক চট্টগ্রাম বন্দর অবশ্য বৃটিশ শাসনকালেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল- ১৮৮৭ সালের ‘দ্য পোর্ট কমিশনার্স এ্যাক্ট’-এর আওতায়। আর আধুনিক ধাঁচে গড়া, নবায়িত বন্দর ১৮৮৮ সালে এক কমিশনারের তত্ত্বাবধানে তার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে। এর ব্যস্ততম বাণিজ্য সংযোগসমূহ স্থাপিত হয়েছিল বৃটিশ বার্মা (হালের মিয়ানমার)-এর সাথে এবং মিয়ানমারের আকিয়াব ও রেঙ্গুন (বর্তমানের ইয়াঙ্গুন) বন্দরের সাথে। সেই সাথে কলকাতা, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের অন্যান্য বাঙালি বন্দরের সাথেও চট্টগ্রাম বন্দরের সংযোগ স্থাপিত হয়। ১৮৮৯-৯০ সালে এই বন্দরে ১২৫,০০০ টন রপ্তানী দ্রব্য আনা হয়। বন্দরের পাশেই গড়ে তোলা হয় ‘স্ট্র্যান্ড রোড’। ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল নাগাদ চট্টগ্রাম পূর্ব বাংলা ও আসামের মুখ্য সমুদ্রবন্দর হয়ে ওঠে। বঙ্গোপসাগর পুনরায় হয়ে ওঠে পৃথিবীর বৃহত্তম জাহাজ ভেড়ার জেটিগুলোর অন্যতম।
দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ পার হয়ে বর্তমান চট্টগ্রাম বন্দর
১৯৪৭-এর দেশভাগের পর তদানীন্তন পাকিস্থান ডমিনিয়নের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ চট্টগ্রামে আসেন এবং এর বন্দরের গুরুত্ব ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। ১৯৬০ সালে ‘দ্য চিটাগাং পোর্ট ট্রাস্ট’ গঠিত হয়। পাকিস্থান আমলের শেষের দিকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্থান আওয়ামী লীগ করাচী বন্দরের পরিবর্তে চট্টগ্রাম বন্দরকে দেশের বৃহত্তম বন্দর হিসেবে তবে, ১৯৭১ সালে বন্দরের প্রায় ১০০ বাঙ্গালি কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
দেশ স্বাধীন হবার পর মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু পরাশক্তি রাষ্ট্র ও তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘দ্য সোভিয়েত প্যাসিফিক ফ্লিট’-কে এই বন্দরের মাইন অপসারণের কাজে নিযুক্ত করা হয়। এবং ১৯৭৩ সালের ১৩ই জুলাই সোভিয়েত ইউনিয়নের সিনিয়র নাবিক ইউরি রেদকিন বন্দর পরিষ্কার ও মাইনমুক্ত করতে গিয়ে একটি মাইন বিষ্ফোরিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্গোপসাগরে মিশে যায় এক ভিনদেশী, পরোপকারী নাবিকের রক্ত।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় প্রচুর ভারি শিল্পের বিকাশ হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরেরও প্রচুর অগ্রগতি সাধিত হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের তিনটি টার্মিনাল বিদেশী কোম্পানীসমূহকে লিজ দেবার সাম্প্রতিক সরকারী সিদ্ধান্ত
গত ১২ই অক্টোবর বাংলাদেশ সরকারের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি সাংবাদিক সম্মেলনের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দর আবার দেশী-বিদেশী নানা সংবাদ মাধ্যমে একটি প্রধান সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠেছে। কী বলা হয়েছিল এই সংবাদ সম্মেলনে?
চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি, লালদিয়ার চর এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও টার্মিনাল ডিসেম্বরের মধ্যে বিদেশি অপারেটরের হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ। তিনি বলেন, তিন টার্মিনালের মধ্যে পানগাঁও ছেড়ে দিতে কিছুটা সময় নেওয়া হবে। এছাড়া নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) অক্টোবরের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল, সেটারও কিছুটা সময় নেওয়া হচ্ছে।
রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইকোনমিক রিপার্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পে বিনিয়োগ সম্ভাবনা’ বিষয়ক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সচিব এ কথা বলেন। মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, আলোচনা শুরু হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি অপারেটরদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক ইস্যু আছে, ভৌগোলিক ইস্যু আছে। আমরা মনে করি, সেটা বড় কোনো বিষয় হবে না। শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বন্দরে বিদেশি অপারেটর কাজ করছে। সেখানে কোনো সমস্যা না হলে এখানে সমস্যা হবে কেন?
মোহাম্মদ ইউসুফ আরো বলেন, ২০২০ সালে সরকার একটি আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয় চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালনা কাঠামো সংস্কারের জন্য। ছয় মাস আগে তাদের রিপোর্ট হাতে এসেছে। সেই সুপারিশ অনুযায়ী বন্দর শুল্ক পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি ডলারে নির্ধারিত বন্দর শুল্ক প্রায় চার দশক পর বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা (আইএফসি) এর পরামর্শেই এই নতুন কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। আইএফসি, যা বিশ্বব্যাংক গ্রুপের একটি অংশ, সরকারকে পতেঙ্গা ও লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালের জন্য কনসেশন চুক্তি প্রণয়নে সহযোগিতা করেছে।
বর্তমানে সৌদি আরবভিত্তিক রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) পরিচালনা করছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল। ডিপি ওয়ার্ল্ড পাচ্ছে নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), যা একাই চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় ৪০% কনটেইনার পরিবহন পরিচালনা করে। আর ডেনমার্কের এপি মোলার মায়ার্স্ক আগ্রহ দেখিয়েছে আইএফসি প্রণীত লালদিয়া টার্মিনালের কনসেশন প্রকল্পে।
নতুন শুল্ক কাঠামো বিশ্লেষণে দেখা যায়, সিপিএ ও বিদেশি অপারেটর উভয়ই আয় বাড়ালেও সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি ঘটেছে সেইসব সেবায়, যেগুলোর আয় সরাসরি টার্মিনাল অপারেটরদের কাছে যায়।
যেমন- কনটেইনার লোডিং-আনলোডিং, ক্রেন পরিচালনা, সংরক্ষণ (স্টোরেজ), রিফার প্লাগ-ইন এবং কনটেইনার স্থানান্তরের শুল্ক গড়ে ১৪৪% পর্যন্ত বেড়েছে। অপরদিকে, পাইলটেজ, ন্যাভিগেশন ও নদী ব্যবহারের মতো সিপিএ-নিয়ন্ত্রিত চার্জ বেড়েছে ৭০ শতাংশের মতো।
উদাহরণ হিসেবে, ২০ ফুট রিফার কনটেইনার প্লাগ-ইন চার্জ ৯ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ২০.৯৬ ডলার, যা সম্পূর্ণ টার্মিনাল অপারেটরের আয়ে যাবে। অন্যদিকে, ১০ হাজার গ্রস রেজিস্টার টন ওজনের জাহাজের ন্যূনতম পাইলটেজ ফি ৩৫৭.৫০ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৮০০ ডলার, যা সিপিএ পাবে।
তবে বন্দরের অধিকাংশ আয় নির্ভর করে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও সংরক্ষণের ওপর। ফলে এই খাতে বেশি শুল্ক বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক অপারেটরদের রাজস্ব বাড়াবে অনেকগুণ, এমনকি রয়্যালটি প্রদানের পরও।
সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, বে-টার্মিনালের দুটি কনটেইনার বার্থ এবং মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরসহ আসন্ন সব নতুন টার্মিনাল বেসরকারি বিশেষত বিদেশি অপারেটরদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় একটি বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন আসছে, যেখানে সরকারি তত্ত্বাবধানে বিদেশি অংশীদারিত্বই হবে ভবিষ্যতের মূল ধারা।
বন্দরের নাম | চট্টগ্রাম বন্দর |
বিদেশী কোম্পানীর কার্য সূচনা (প্রত্যাশিত) | ডিসেম্বর ২০২৫ |
আলোচিত টার্মিনালসমূহ | লালদিয়া টার্মিনাল, নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল এবং পনগাঁও টার্মিনাল |
ইজারার মেয়াদ (লালদিয়া) | ৩০ বছর |
ইজারার মেয়াদ (নিউ মুরিং ও পানগাঁও) | প্রতিটি বন্দরে ইজারার মেয়াদ |
জাতীয় বাণিজ্যে বন্দরের অংশ | বাংলাদেশের মোট আমদানি-রপ্তানী বাণিজ্যের ৯২ শতাংশ |
শুল্ক বৃদ্ধি | ৪০% শতাংশ |
প্রধান বিরোধী দল বা গোষ্ঠিসমূহ | বিএনপি, জামাত-ই-ইসলামী, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ |
সরকারের যুক্তি | দক্ষতা বৃদ্ধি ও উচ্চ সরবরাহ ব্যয় হ্রাস |
স্বচ্ছতা রাখায় যা করা যেতে পারে | বিদেশী কোম্পানীর সাথে সম্পাদিত চুক্তিসমূহ অন্তর্জালে প্রকাশ করা। |
ইতোমধ্যে সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে খোদ বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত তারেক জিয়া এক বিবৃতিতে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন। এছাড়া বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-ও এর প্রতিবাদ করেছে।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিলে তা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থের জন্য ভয়াবহ হুমকি তৈরি করবে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি অভিযোগ করেছেন, সরকার বন্দরের আশপাশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে জনগণের প্রতিবাদ বন্ধের চেষ্টা করছে, যেন এই এক মাসের মধ্যেই বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে গোপন চুক্তি সম্পন্ন করা যায়। চট্টগ্রাম নগরীর জিয়া স্মৃতি যাদুঘর সেমিনার হলে ‘জাতীয় সক্ষমতা ও জাতীয় নিরাপত্তা: চট্টগ্রাম বন্দর ও বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন আনু মুহাম্মদ। সভাটি যৌথভাবে আয়োজন করে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন।
আনু মুহাম্মদ বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক কৌশলের অন্যতম কেন্দ্র। এমন একটি জাতীয় সম্পদ বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া মানে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপস করা। বন্দরকে অবশ্যই জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালনা করতে হবে, অন্যথায় এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তিনি অভিযোগ করেন, বর্তমান সরকার জনগণের বিরোধিতা ও আলোচনার সুযোগ না দিয়েই দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে গোপন চুক্তি করার চেষ্টা করছে। সংবিধান সংস্কার কমিটি বিদেশের সঙ্গে যেকোনো বড় চুক্তির আগে জনগণের মতামত নেওয়ার সুপারিশ করেছে, কিন্তু সরকার নিজের গঠিত কমিশনের সেই সুপারিশও মানছে না। তার মতে, ডিপি ওয়ার্ল্ড কেবল একটি আরব কোম্পানি নয়, বাস্তবে এটি মার্কিন স্বার্থরক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে আমেরিকা এখন চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী। এমন অবস্থায় বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া মানে দেশের কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ হারানো।
একই সভায় ‘চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, “বন্দর ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দিলে দেশ উন্নত হবে এই প্রচারণা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নয়, বিদেশি চাপের কাছে দায়বদ্ধ।” সাংবাদিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী বলেন, “১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার আমলে চট্টগ্রাম বন্দর মার্কিন কোম্পানি এসএসএ-কে ১৯৮ বছরের জন্য ইজারা দেওয়ার চুক্তি হয়েছিল, যা জনগণের আন্দোলনের মুখে বাতিল হয়। এখনো সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে।” শ্রমিক নেতা শেখ নুরুল্লাহ বাহার বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের স্বার্থের চেয়ে বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। বন্দর কর্মচারীদের শোকজ, বরখাস্ত ও সমাবেশ নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে সরকার হাসিনা আমলের দমননীতিকেই পুনরুজ্জীবিত করছে।”
শেষ কথা: সপ্তম শতকে চৈনিক পরিব্রাজক ঝুয়ান জাং বাংলাদেশের বৃহত্তম বন্দর নগরীকে ‘কুয়াশা ও জল থেকে উত্থিত এক নিদ্রিতা সুন্দরী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। এই অপরূপা বন্দরকে যেন আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চীন-রাশিয়া অথবা ভারত সহ পৃথিবীর কোন দেশের হাতেই তুলে না দিই- চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্মারক- এটা যেন ভুলে না যাই।
অদিতি ফাল্গুনী: কবি, শব্দশিল্পী ও অনুবাদক; দীর্ঘ সময় ধরে তিনি গণমাধ্যম ও উন্নয়ন খাতে কর্মরত আছেন।