সর্বশেষ

মতামত

নোবেল পুরস্কার, সাম্রাজ্যবাদ ও দক্ষিণ এশিয়ার নতুন রাজনৈতিক ছক

প্রকাশিত: ১২ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:০৪
নোবেল পুরস্কার, সাম্রাজ্যবাদ ও দক্ষিণ এশিয়ার নতুন রাজনৈতিক ছক

২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণার পর লাতিন আমেরিকা থেকে দক্ষিণ এশিয়া-দুই প্রান্তেই এক প্রশ্ন আবার জেগে উঠেছে; নোবেল কি এখন শুধুই মানবতার প্রতীক, নাকি এটি হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক রাজনীতির কূটনৈতিক হাতিয়ার? ভেনেজুয়েলার বিরোধী রাজনীতিক মারিয়া কোরিনা মাচাদো–কে শান্তি পুরস্কার দেওয়া যেমন মার্কিন প্রভাববিস্তারী কৌশলের অভিযোগ উস্কে দিয়েছে, তেমনি বাংলাদেশে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস–এর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড পরবর্তী রাজনৈতিক পুনরুত্থান নিয়েও নতুন  প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে।

 

লাতিন আমেরিকায় মাচাদো “গণতন্ত্রের প্রতীক” হিসেবে নোবেল পেলেও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি মার্কিন নীতির অন্ধ সমর্থক, যিনি ভেনেজুয়েলার সমাজতান্ত্রিক সরকার উৎখাতের পক্ষে বিদেশি হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, এই পুরস্কার আসলে ভেনেজুয়েলায় ‘”গণতন্ত্র” নয় বরং মার্কিনপন্থী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এক কূটনৈতিক বার্তা।

 

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ-তিনি মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করেছেন, যা সাধারণ ভেনেজুয়েলাবাসীর জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করেছে। এমনকি, কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে ভেনেজুয়েলায় “গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা”দিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর দল Vente Venezuela–র সঙ্গে ইসরায়েলের লিকুদ পার্টির যোগাযোগ নিয়েও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন  প্রকাশিত হয়েছে। এই তথ্যগুলো মাচাদোকে “ওয়াশিংটন–তেল আভিভ অক্ষের প্রতিনিধি” হিসেবে চিত্রিত করেছে লাতিন আমেরিকার বামপন্থী মহলে।

 

ভেনেজুয়েলার সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের প্রচেষ্টায় দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ সুপরিচিত। এমন প্রেক্ষাপটে একজন মার্কিনপন্থী রাজনীতিককে শান্তি পুরস্কার দেওয়া-তা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক বার্তা বহন করে। এতে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ভাষায় আড়ালে লুকানো সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের অভিযোগ অস্বীকার করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

 

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত শুধু একটি মানবাধিকার কর্মীকে সম্মানিত করা নয়-এটি এক ধরনের রাজনৈতিক সংকেতও। পশ্চিমা বিশ্বে যখন বামমুখী সরকারগুলো পুনরায় উত্থান ঘটাচ্ছে; তখন নোবেল কমিটির এই পুরস্কার লাতিন আমেরিকায় ডানপন্থী জোটগুলোকে মনোবল জোগাবে বলেই মনে করছেন অনেকে।

 

একই ছাঁচ দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়ও-বিশেষত বাংলাদেশে। এখানেও “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের” নামে এক ধরনের ভূ-রাজনৈতিক প্রজেক্ট সক্রিয় হয়ে উঠেছে; যার ছায়ায় নোবেলজয়ী ইউনুসের নাম ব্যবহার হচ্ছে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে।

 

বাংলাদেশ আজ চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ হঠাৎই রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপে। প্রশাসনিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে, রাষ্ট্রযন্ত্র বিভক্ত; সেনাবাহিনীর মধ্যেও অস্থিরতা ও ক্ষোভের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে।

 

এর পাশাপাশি ইসলামিক ভাবাপন্ন দলগুলো-বিশেষ করে কট্টরপন্থী সংগঠনগুলো-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু দখল করতে শুরু করেছে। ধর্মীয় উত্তেজনা, সামাজিক অনিরাপত্তা ও সহিংসতার সম্ভাবনা সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।

 

এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ভূমিকাকে অনেক বিশ্লেষক লাতিন আমেরিকার পুরোনো ‘রেজিম-চেঞ্জ প্যাটার্ন’-এর সঙ্গে তুলনা করছেন। সেখানে যেমন সমাজতান্ত্রিক সরকারগুলোর বিরুদ্ধে “গণতন্ত্র” ও “মানবাধিকার”-এর ব্যানারে নতুন নেতৃত্ব দাঁড় করানো হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’–এর ছায়ায় এক ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক রূপান্তর প্রকল্প এগোচ্ছে-যার উপরে পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

 

নোবেল কমিটি সবসময় বলে এসেছে-তাদের পুরস্কার ‘রাজনৈতিক নয়’, ‘মানবিক সাহসের স্বীকৃতি’। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এই পুরস্কার বহুবার রাজনৈতিক প্রভাবের হাতিয়ার হয়েছে। অং সান সুচি’র ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছিলাম, এক সময় তিনি গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে নোবেল পেয়েছিলেন; পরে রোহিঙ্গা গণহত্যায় নীরব ভূমিকা রাখায় তাঁর সেই ‘প্রতীকী মর্যাদা’ ভেঙে পড়ে।

 

আজ একই নৈতিক প্রশ্ন আবার উঠছে-নোবেল কি সত্যিই মানবতার পুরস্কার, নাকি তা সময়ের প্রেক্ষিতে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর নীতি বাস্তবায়নের এক নরম কূটনৈতিক উপকরণ?

 

বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতা এই প্রশ্নকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলছে। এখানে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নির্বাচন–এই শব্দগুলো এখন আর কেবল রাজনৈতিক নয় বরং ভূরাজনৈতিক অস্ত্র। বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর চাপ, আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি  এবং স্থানীয় রাজনীতিতে আমদানি করা “গণতন্ত্রের সংজ্ঞা”-সব মিলে এক জটিল কৌশলগত বাস্তবতা তৈরি হয়েছে।

 

আজকের বাংলাদেশ ঠিক সেই মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে ভেনেজুয়েলা ছিল কয়েক বছর আগে। সেখানে ‘গণতন্ত্র’-এর নামে শুরু হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী কূটনৈতিক অভিযান; এখানে ‘অন্তর্বর্তীকালীন স্থিতি’র আড়ালে হয়তো শুরু হচ্ছে তার দক্ষিণ এশীয় সংস্করণ।

 

সবশেষে প্রশ্নটা একটাই; যদি নোবেল এখন “গণতন্ত্রের” নামে সাম্রাজ্যবাদের কূটনৈতিক প্রতীক হয়ে ওঠে তবে বাংলাদেশ কি আবার এক নতুন বৈদেশিক পরীক্ষাগারের অংশ হতে যাচ্ছে? ইতিহাস বলে-এই পরীক্ষাগারে শান্তি নয় বরং বিশৃঙ্খলাই জন্ম নেয় ।

সব খবর