সর্বশেষ

যে কণ্ঠগুলো আমাদের প্রয়োজন ছিল, আজও আছে

প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২:১২
যে কণ্ঠগুলো আমাদের প্রয়োজন ছিল, আজও আছে

বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী চিন্তার ইতিহাসে দুটি নাম গভীরভাবে উজ্জ্বল—আহমদ ছফা ও হুমায়ুন আজাদ। তাঁদের লেখনী শুধু সাহিত্য নয়, ছিল সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্য উচ্চারণের লড়াই। আজ যখন যুক্তিবাদিতা, মানবিকতা ও চিন্তার স্বাধীনতা হুমকির মুখে, তখন তাঁদের মত কণ্ঠ আরও বেশি করে প্রয়োজন।

আহমদ ছফা ছিলেন চিন্তার বিপ্লবী সৈনিক। তিনি ধর্মীয় মৌলবাদ, মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদিতা ও রাজনৈতিক দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে ছিলেন আপসহীন। ছিলেন অন্যরকম একজন লেখক—সাহিত্যিক,  প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এবং দার্শনিক চিন্তার ধারক। তাঁর বই “বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস” শুধু একটি প্রবন্ধ সংকলন নয়, এটি ছিল বাংলাদেশের অবহেলিত আত্মার আর্তনাদ। এই গ্রন্থে তিনি আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন। তাঁর প্রণিধানযোগ্য উক্তি: “ধর্ম যখন রাজনীতির হাত ধরে চলে, তখন ধর্ম যেমন কলুষিত হয়, রাজনীতিও হয় নীতিহীন।”

 

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা গণহত্যা চালিয়েছে, সেই রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদারদের বিচারহীনতা নিয়ে গভীর বেদনা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। ছফা ছিলেন সেই বিরল মানুষদের একজন, যিনি প্রথম থেকে বুঝেছিলেন—বাংলাদেশ যদি তার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলে যায়, তবে একদিন ইতিহাস প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করবে।
 

বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা যেন সংবিধানের পাতায় সীমাবদ্ধ একটি ধারণা। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও, ১৯৭৫-এর পরবর্তী কালপর্বে সামরিক ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের সময় ধর্মীয় উগ্রতা রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠে। সেই ধারাবাহিকতায়ই ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের পর দেখতে পাই—একটি সুসংগঠিত মৌলবাদী কাঠামো, যারা একের পর এক মুক্তমনা লেখক ও ব্লগারদের হত্যা করতে থাকে।

 

আহমদ ছফা ছিলেন — জাতির আত্মপরিচয়, স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে এক অকুতোভয় কণ্ঠস্বর। তিনি সেই বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি সত্য বলার দায়ে রাজনীতিকদের অপছন্দের তালিকায় ছিলেন। আজকের বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপটে হুমায়ুন আজাদ ও আহমদ ছফার প্রয়োজনীয়তা নতুনভাবে এবং তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। তাঁরা এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয়, ওয়াশিকুর রহমান, নীলাদ্রী নীল—এরা সবাই ছিল আজাদ-ছফার চিন্তার উত্তরাধিকারী। যারা নিজেরাই পরিণত হয়েছেন শহিদে।

 

হুমায়ুন আজাদ ছিলেন ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তলোয়ারধারী এক সাহিত্যিক। ছিলেন যুক্তিবাদের এক কঠোর প্রবক্তা। তাঁর লেখা “পাক সার জমিন সাদ বাদ” এক যুগান্তকারী সাহিত্যকর্ম, যেখানে তিনি ধর্মীয় উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পাকিস্তানি রাজনীতির পুনরুত্থানের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন।

 

হুমায়ুন আজাদ কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড় হননি; তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র, যুক্তিনিষ্ঠ ও নির্মোহভাবে স্পষ্টবাদী। সমাজে এমন বুদ্ধিজীবীর প্রয়োজন, যারা ক্ষমতার মুখে নির্ভয়ে “না” বলতে পারেন। সত্য উচ্চারণের কারণেই ২০০৪ সালে মৌলবাদী জঙ্গিদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বহুল আলোচিত গ্রন্থ আমার অবিশ্বাস-এ আজাদ লিখেছিলেন—“আমি ধর্ম নয়, মানুষে বিশ্বাসী।” অথচ এ ধরনের মানবিক ও যুক্তিনিষ্ঠ উচ্চারণ আজকের বাংলাদেশে হয়ে উঠেছে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ।

 

শাহবাগ আন্দোলনের পর একে একে মুক্তচিন্তার লেখকদের হত্যা, ২০২৪ এর জুলাই আগস্টে আন্দোলনের নামে ছাত্রদের প্রতারিত করা, ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টি করে গত এক বছরে একশোর উপরে মাজারে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও আতঙ্ক - সব মিলিয়ে বোঝা যায়, রাষ্ট্র একটি বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়াশীল ইতিহাসের দিকে মোড় নিয়েছে। এই বাস্তবতায় আহমদ ছফার সতর্কবাণী যেন ভবিষ্যদ্বাণী হয়ে ফিরে আসে, “যে জাতি ইতিহাসের শিক্ষা নেয় না, সে জাতির ওপর ইতিহাস প্রতিশোধ নিতে জানে।”

 

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর দণ্ডপ্রাপ্ত অসংখ্য ইসলামী জঙ্গির জেল থেকে পলায়ন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী রাজাকার আজহারুল ইসলামের খালাস পাওয়া এবং বিচারব্যবস্থার রাজনৈতিক ব্যবহারে স্পষ্ট  হয়—আমরা একটি প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রীয় ধারায় প্রবেশ করছি, যা যুক্তি, মানবিকতা ও স্বাধীনতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

 

আহমদ ছফা সতর্ক করে দিয়েছিলেন—“ধর্ম রাজনীতির হাত ধরে চললে, ধর্ম কলুষিত হয়।” আজকের বাংলাদেশে সেই সতর্কবাণী নির্মম বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠনগুলো—যেমন জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম—আবারও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে উন্মত্ত। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যার সহযোগী ঘাতকদল জামায়াত সরাসরি স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, অথচ আজও তারা রাজনৈতিক মঞ্চে সক্রিয় এবং নানা উপায়ে রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করছে। 

 

অন্যদিকে, হেফাজতে ইসলাম ধর্মের নামে সমাজকে পিছিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষানীতিতে হস্তক্ষেপ করে এক ধরনের ধর্মতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় ছফার সতর্কবাণী কেবল অতীতের তত্ত্ব নয়, বরং বর্তমান বাংলাদেশের কঠিন বাস্তবতা।

 

আহমদ ছফা ও হুমায়ুন আজাদ দু’জনেই স্পষ্টভাবে চাটুকারিতা ও বুদ্ধিজীবীদের লেজুড়বৃত্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় দেখা যায়, শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একটি বড় অংশ সুবিধাবাদী অবস্থানকে বেছে নিয়েছে। তারা ক্ষমতার চারপাশে ঘুরপাক খাওয়া আর তোষামোদকেই ‘চিন্তাচর্চা’ নামে আড়াল করার চেষ্টা করছে। অথচ ছফা একসময় তীব্র ভাষায় লিখেছিলেন—“দেশের মাটি যাদের কাছে ঋণী, সেই মানুষদের আজকের বাংলাদেশ চেনে না; বরং চেনে চাটুকারদের।” তার এ কথার ভেতরেই লুকিয়ে আছে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির গভীর সংকটের নির্মম প্রতিচ্ছবি।

 

এই অবস্থায় হুমায়ুন আজাদ ও আহমদ ছফার মত মানুষদের কণ্ঠ আমাদের আত্মরক্ষার হাতিয়ার। তাঁরা কোনোদিন ক্ষমতার কাছে মাথা নত করেননি বরং শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের মত চিন্তাবিদদের লেখা ও বক্তব্যই ধর্মীয় উগ্রতার বিরুদ্ধে আদর্শিক প্রতিরোধ গড়ার হাতিয়ার হতে পারে। তাঁরা ছিলেন এবং আছেন—আমাদের বিবেক হয়ে। আহমদ ছফা ও হুমায়ুন আজাদ আমাদের ইতিহাসের এমন দুই অধ্যায়, যাঁদের পাঠ না করলে আমরা ভুল ইতিহাস শিখি, ভুল ভবিষ্যতের দিকে এগোই। তাঁরা একা লড়েছেন, কিন্তু তাঁদের ভাবনা ছিল সময়ের ঊর্ধ্বে। তাঁরা আমাদের শিখিয়ে গেছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা শুধু অধিকার নয়, তা জাতির ভবিষ্যতের শর্ত।

 

আজকের বাংলাদেশে আহমদ ছফা ও  হুমায়ুন আজাদ কেবল একটি স্মৃতি নয় বরং এক বিকল্প ভবিষ্যতের প্রতীক। যে ভবিষ্যত যুক্তিনির্ভর, ন্যায্যতাভিত্তিক এবং মানবিক। রাষ্ট্র যদি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরতে চায়, তবে তা করতে হবে চিন্তার স্বাধীনতাকে সম্মান দিয়ে, মতপ্রকাশকে উৎসাহ দিয়ে। হুমায়ুন আজাদের সাথে আহমদ ছফা-কে যুক্ত করা আমাদের এই সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, কারণ তাঁরা দুজনই ছিলেন বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরের বিবেক। দুজনেই ছিলেন স্পষ্টবাদী, নীতিনিষ্ঠ এবং চিন্তার স্বাধীনতার জন্য আপসহীন।
 

জয় হোক যুক্তির, জয় হোক সাহসিকতার, জয় হোক মানুষের।

সব খবর