বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ আবারও সামনে এসেছে। সম্প্রতি ইউনূস সরকারের প্রেস উইং থেকে আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা রয়টার্সকে ‘হুমকি’ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারের সমালোচনা করলেই বিদেশি গণমাধ্যমকে ‘প্রতিক্রিয়ার মুখে’ পড়তে হচ্ছে এমন পরিস্থিতিকে বিশ্লেষকরা বাংলাদেশের গণমাধ্যম ইতিহাসের এক নতুন অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে দেখছেন।
সমালোচনায় সহ্যসীমা হারিয়েছে সরকার
প্রেস উইংয়ের উপ-প্রেস সচিব আজাদ গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে রয়টার্সের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনকে “সাংবাদিকতার মানদণ্ড বহন করে না” বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, “রয়টার্সের প্রতিবেদনে পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উপস্থাপনা রয়েছে।”
কিন্তু সাংবাদিক মহল বলছে, এই মন্তব্য শুধু একটি বিদেশি সংস্থাকে লক্ষ্য করে নয়, বরং পুরো সংবাদজগতের ওপর ভয় দেখানোর ইঙ্গিত। কারণ সরকারের সমালোচনামূলক যেকোনো প্রতিবেদন প্রকাশ পেলেই সেটিকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ হিসেবে দেখানোর প্রবণতা এখন ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
দেশে সংবাদমাধ্যমের গলা চেপে ধরা বাস্তবতা
বাংলাদেশে গত এক বছরের বেশি সময় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে ভয়াবহভাবে। ডজনখানেক সম্পাদক অপসারণ, সাংবাদিক ও টেলিভিশন টকশো বন্ধের ঘটনা প্রমাণ করে, ভিন্নমত সহ্য করতে পারছে না বর্তমান প্রশাসন।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, “দেশে মিডিয়া এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে সংবাদ প্রকাশের আগে ‘কী বলা যাবে, কী বলা যাবে না’—তা নির্ধারণ হয় রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা।”
শুধু দেশীয় নয়, এখন বিদেশি সংবাদমাধ্যমও একই নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা হচ্ছে। রয়টার্স, বিবিসি, আল জাজিরা বা দ্য গার্ডিয়ানের মতো প্রতিষ্ঠানও বাংলাদেশে রিপোর্টিংয়ে বাধা ও নজরদারির মুখে পড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ইউনূস সরকারের প্রতিহিংসামূলক আচরণ
বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতা দখলের পর থেকেই বর্তমান সরকার কঠোরভাবে সমালোচনাকে দমন করছে। নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের প্রতিহিংসামূলক মনোভাব কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, সাংবাদিকতাকেও টার্গেট করেছে।
অর্থনীতি, মানবাধিকার কিংবা প্রশাসনিক দুর্নীতি নিয়ে যেকোনো সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ হলে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদ, মামলা কিংবা হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে।
এক প্রবীণ সাংবাদিক বলেন, দেশে সাংবাদিকদের এখন দুই ভয়—একদিকে রাষ্ট্রীয় হুমকি, অন্যদিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের বাধ্যবাধকতা। এর ফলে সত্য প্রকাশের জায়গা দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে।”
বিদেশি মিডিয়া ‘দেশীয় শৃঙ্খলে’
প্রচলিতভাবে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে বোঝা যাচ্ছে, সরকার বিদেশি সাংবাদিকদেরও ‘দেশীয় মিডিয়ার মতো’ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে।
মিডিয়া পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এটি এক ভয়াবহ নজির, যা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরও বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এক বিশ্লেষক মন্তব্য করেন, “যখন কোনো সরকার নিজের দেশে ভিন্নমতকে ভয় পায়, তখন সে বিদেশি চোখকেও অন্ধ করতে চায়। আজ সেটাই ঘটছে বাংলাদেশে।”
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য বিপদসীমা অতিক্রম
রয়টার্সকে হুমকি দেওয়ার ঘটনা শুধু একটি সংস্থাকে লক্ষ্য করে নয়—এটি বাংলাদেশের সংবাদ স্বাধীনতার অবশিষ্ট পরিসরকেও চ্যালেঞ্জ জানায়। সত্য প্রকাশের ভয়, সেন্সরশিপ, এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার যুগে দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে।
যদি অবিলম্বে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হয়, তবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে “নীরব রাষ্ট্র” হিসেবে পরিচিত হওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়।