সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের যুব মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তি রাজনৈতিক অঙ্গন ও নাগরিক সমাজে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের তরুণদের আত্মরক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সরকার বলছে- এটি একটি আত্মরক্ষামূলক উদ্যোগ। আর নেতৃত্বে আছেন শান্তির নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূস! শান্তির প্রতীক হাতে, কিন্তু সরকারের ঘোষণা যেন যুদ্ধের ঢোল বাজাচ্ছে। কিন্তু জনগণ প্রশ্ন তুলছে- দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি কি এতটাই ভয়াবহ যে, তরুণদের হাতে এখন অস্ত্র তুলে দেওয়াই একমাত্র সমাধান?
এই ‘শান্তির অস্ত্র প্রকল্প’-এর দায়িত্বে আছেন যুব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া-যিনি বিতর্কে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাঁর অতীত কর্মকাণ্ডে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে বহুবার, কিন্তু অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার তাতে নির্বিকার। হয়তো শান্তির নতুন সংজ্ঞা এখন এমনই-বিতর্কে শান্ত থাকা! ফলে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এই সংবেদনশীল উদ্যোগের পেছনে কি আসলে সরকারের অনুমোদন রয়েছে, নাকি এটি প্রশাসনের একক মহলের কৌশল?
২০২৪ সালের আগস্টের ৫ তারিখ থেকে বাংলাদেশ ভয়াবহ নিরাপত্তা সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। সেসময় দেশের ৪০০-রও বেশি থানায় হামলা আগুন ও লুটপাট হয়। শতাধিক পুলিশ নিহত হন, আর সরকারি হিসাবে প্রায় কয়েক হাজার অস্ত্র লুট হয়। এখনও প্রায় সাত হাজার অস্ত্র ও কয়েক লাখ গুলি উদ্ধার হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে তরুণদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের ঘোষণা স্বাভাবিকভাবেই জনমনে উদ্বেগ তৈরি করেছে। মানুষ জানতে চায়- যে অস্ত্রগুলো এখনো উদ্ধার হয়নি, সেগুলো কারা ব্যবহার করছে? কাদের বিরুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহারের প্রস্তুতি চলছে? নাকি কোনো অদৃশ্য শক্তি ইতিমধ্যেই নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে?
রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বিষয়টি কেবল নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়-এর পেছনে রাজনৈতিক ও আদর্শিক প্রভাবও থাকতে পারে। কারণ, এনসিপি–ঘনিষ্ঠ কিছু সংগঠনের তরুণদের মধ্যে উগ্র ইসলামী মনোভাব, এমনকি প্রতিবেশী ভারত-বিরোধী প্রচারণার প্রবণতা নিয়েও আলোচনা রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অতীতের ভয়ংকর স্মৃতি-১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে এই দেশেরই কিছু তরুণ, যারা জামায়াত-শিবিরের আদর্শে বিশ্বাসী ছিল, তারা দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের হত্যা করেছিল। সেই ধারাবাহিকতায় আজ যদি কোনো উগ্র গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় আশ্রয়ে অস্ত্র হাতে পায়, তাহলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।
এর চেয়েও উদ্বেগের বিষয়-সরকার এখনো পর্যন্ত ২০২৪ সালের হামলা, অস্ত্র লুট, কিংবা পুলিশ হত্যার ঘটনার কোনো স্বচ্ছ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। বরং দেখা যাচ্ছে, পুলিশ প্রশাসনকে ধীরে ধীরে নিস্ক্রিয় করে ফেলা হচ্ছে, সামরিক বাহিনীকে নানা বিতর্কে টেনে দুর্বল করা হচ্ছে। ফলে একটি সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কাঠামো এখন অচলাবস্থায়। প্রশ্ন উঠছে-এই অবস্থায় অস্ত্র প্রশিক্ষণ কার স্বার্থে? এমন অবস্থায় হঠাৎ তরুণদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করা-এটা কি নিরাপত্তা নাকি ভয় তৈরির রাজনীতি? এটি কেবল ভুল রাজনৈতিক বার্তা নয়-সমাজে বিভাজন ও সহিংসতার বীজ বপন করতে পারে।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। গত ১৪ মাসে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বেকার হয়েছেন; ১৬ হাজারের বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, যুব সমাজকে দক্ষ করে তোলা এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা। অথচ দেখা যাচ্ছে, সরকার তরুণদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে চাইছে। ইউনূস সরকারের যুক্তি যেন অন্য রকম: শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আগে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে!
বহু পর্যবেক্ষক মনে করেন, আসিফ মাহমুদ ভূঁইয়ার মতো ব্যক্তির হাতে এ ধরনের প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া একটি বড় ভুল। তিনি ২০২৪ সালের আন্দোলনের পর প্রকাশ্যে বলেছিলেন, “আন্দোলন সফল না হলে আমরা অস্ত্র হাতে নিতাম।” এমন ব্যক্তির নেতৃত্বে যদি অস্ত্র প্রশিক্ষণের মতো কর্মসূচি শুরু হয়, তবে তা আত্মরক্ষা নয় বরং একপ্রকার সশস্ত্র রাজনৈতিক প্রস্তুতি হিসেবে ধরা দেবে। ইতিহাসের ব্যঙ্গ হয়তো এত নির্মম আগে কখনো হয়নি। যে সরকারের নেতৃত্বে একজন নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী, তার আমলে তরুণদের হাতে বন্দুক-এ যেন গান্ধীর হাতে বোমা, আর রবীন্দ্রনাথের হাতে রাইফেল কল্পনা করার মতোই অস্বাভাবিক।
অধ্যাপক ইউনূস শান্তিতে নোবেলজয়ী ব্যক্তি-তিনি যদি সত্যিই শান্তি ও মানবতার পক্ষে থাকেন, তবে তার সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তের যুক্তি জনগণের সামনে ব্যাখ্যা করা উচিত। নতুবা এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠবে- তিনি কি এমন এক বাংলাদেশ গড়তে চাইছেন, যেখানে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সংঘাতের রাজনীতিই হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ? এমন হলে ইতিহাস তাকে মনে রাখবে এক নতুন উপাধিতে-“শান্তির নোবেলজয়ী, যুদ্ধের কৌশলবিদ।”
বাংলাদেশের ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে-যখন তরুণদের হাতে অস্ত্র দেওয়া হয়, তখন তার ফল- হয় স্বাধীনতা, নয় ধ্বংস। ১৯৭১-এ সেই অস্ত্র মুক্তির প্রতীক ছিল। কিন্তু আজ যদি সেই অস্ত্র উগ্রতা, বিভাজন আর প্রতিশোধের প্রতীক হয়ে ওঠে-তাহলে বাংলাদেশ আরেকটি ভয়ংকর সন্ধিক্ষণের দিকে এগোবে।
রাষ্ট্র এখন যে দিকেই যাক, নাগরিক সমাজের দায়িত্ব হলো প্রশ্ন করা- তরুণদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন? কোন শান্তির জন্য? এ প্রশ্নগুলোই আজ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।