হিমালয় দুহিতা নেপাল হুট করেই যেন হয়ে উঠেছে লাভা উদ্গীরণরত এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। ভিসুভিয়াসের প্রাকৃতিক ভাবে বিষ্ফোরিত লাভায় ধ্বংস হয়েছিল ইতালীর পম্পেই নগরী। নেপালে জেন জি প্রজন্মের হাতে ধরানো আগুনে পুড়ছে সেদেশের সংসদ ভবন বা ‘সিংহ দরবার’ এবং এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঝালানাথ খানালের স্ত্রী রবিলক্ষী চিত্রকরকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার সংবাদ সারা পৃথিবীতে আলোড়ন তুললেও নানা সংবাদমাধ্যমেই তিনি এখনো কাঠমান্ডুর কীর্তিপুর হাসপাতালে আইসিইউ-তে রয়েছেন বলে জানা গেছে। যেন চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই, গত কয়েক দিনে নেপাল হুট করে হয়ে উঠেছে সারা পৃথিবীর মনোযোগের কেন্দ্র। কিন্তু এমনটা কেন হলো আর কীভাবেই বা হলো? এ নিয়ে কী বলছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো? খুবই নিরপেক্ষ একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিডি ভয়েস লিখতে চাচ্ছে বলে সিএনএনে-র একাধিক প্রতিবেদন, বিবিসি-র একটি প্রতিবেদন, টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র একটি প্রতিবেদন এবং একটি রুশ সংবাদমাধ্যম থেকে রুশ ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত সমন্বিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই নিবন্ধ তাই পাঠক সমীপে পেশ করা হবে।
প্রথমে না হয় নেপাল প্রসঙ্গে মার্কিনী সংবাদ মাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদন দিয়েই শুরু করা যাক। গত ৯ই সেপ্টেম্বর ‘আ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যান, করাপশন এ্যান্ড নেপো কিডস: হোয়াট উই নো এ্যাবাউট দ্য ডেডলী প্রোটেস্টস দ্যাট আউস্টেড নেপালস লীডার’ শিরোনামে লেক্স হার্ভে, সুগম পোখারেল, এশা মিত্র এবং ঐশ্বর্য এস আয়ারের যৌথ প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, নেপালী সরকারের রক্তাক্ত দমন-পীড়নের প্রতিবাদে নেপালী বিক্ষোভকারীরা আজ পুলিশী কার্ফ্যূ অস্বীকার করে মঙ্গলবার রাজধানী কাঠমান্ডু শহরের সড়কগুলোর দখল নিয়ে নেয়, সুপ্রীম কোর্ট, সংসদ ভবন এবং অন্যান্য সরকারী ভবনেও আগুন ধরিয়ে দেয়। জেন-জি প্রজন্মের এই বিক্ষোভে এই হিমালয় দুহিতা দেশের প্রধানমন্ত্রীর ইতোমধ্যে পতন হয়েছে।
সেদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত সূত্রগুলোর মতে, সরকারের সাথে বিক্ষোভকারীদের সঙ্ঘর্ষে ইতোমধ্যে ২২ জন নিহত হয়েছেন এবং একশোর মত মানুষ আহত হয়েছেন। আপাত:দৃষ্টে সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করার প্রতিবাদে এই সঙ্ঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লেও আসলে এই বিক্ষোভের শেকড় সেদেশের রাজনৈতিক ভাবে অভিজাত গোষ্ঠির নির্বিচার দুর্নীতি এবং সাধারণ নেপালীদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে গভীরভাবে প্রোথিত।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের মতে, বিক্ষোভকারীদের দমন করতে পুলিশ তাজা গুলি, জলকামান এবং টিয়ার গ্যাস ছুঁড়েছে। মঙ্গলবার রাজধানীর আকাশ কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। দেশটির মূল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এই সহিংসতার মুখে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যাতেই নেপাল সেনাবাহিনী ‘নেপাল ও নেপালীদের নিরাপত্তার জন্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে’ কাঠমান্ডুতে বাহিনী পাঠায়, অন্তত: সেদেশের সেনাপ্রধান তেমনটিই বলেছেন।
ত্রিশ মিলিয়ন বা তিন কোটি মানুষের দেশ নেপাল তার ঝঞ্চা-বিক্ষুব্ধ রাজনীতির জন্য পরিচিত। ২০০৮ সালে একটি দশকব্যপী গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষিতে এর ২৩৯-বছরের পুরনো রাজতন্ত্রের পতনের পর ‘প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে আত্মপ্রকাশের রূপান্তরকালীন সময়ে গত সতেরো বছরে বারো বারের বেশি সরকার বদল হয়েছে। তবে নেপালে জেন জি প্রজন্ম চালিত (১৩-২৮ বছর বয়সী প্রজন্ম) এই বিক্ষোভ গত দশকগুলোর ভেতর নেপালের মন্দতম অস্থিরতা বলেই মনে করা হচ্ছে।
গত এক যুগ ধরেই সরকারের দুর্নীতি সমাজের ভেতর ক্ষোভ হয়ে ফুঁসছিল যা গত সপ্তাহে হুট করেই সরকার ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব এবং এক্স হ্যান্ডেল বন্ধ করার পর সেই বিক্ষোভের স্রোত রাস্তায় ছিটকে পড়ে। সরকারের এই নীতি সেদেশের নাগরিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার গোষ্ঠিগুলো তীব্র ভাবে সমালোচনা করে।
এই বিক্ষোভ আন্দোলনের সংগঠকদের মতে, শুধুমাত্র সামাজিক মাধ্যম ব্যান করার জন্য বিক্ষোভ হয়নি বরং সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অসহায়ত্বজনিত হতাশা থেকেই এই নৈরাজ্যের সূচনা। ‘যদিও সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করার সাম্প্রতিক সরকারী পদক্ষেপই এই বিক্ষোভকে উস্কে দেয়, তবে পেছনে বহু বছরের দুর্নীতির দীর্ঘ ইতিহাস এবং সুশাসনের অভাবই হাজার হাজার মানুষকে পথে টেনে এনেছে,’ আঠাশ বছরের এক প্রতিবাদকারী সিএনএনকে গত সোম ও মঙ্গলবার একথা জানান।
‘জনতার এই তীব্র শক্তি এবং ক্রোধ দেখে বিহ্বল বোধ করা ছাড়া উপায় নেই,’ সরকারী দমননীতির ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই প্রতিবাদকারী বলেছেন সিএনএনকে।
২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী নেপালে ১৫-২৪ বছর বয়সী তরুণদের ভেতর বেকারত্বের হার ২০.৮% শতাংশ। ইতোমধ্যে, ‘নেপো কিডস’ বা নেপালী রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসী জীবনযাত্রার বিরুদ্ধে অন্তর্জালে ভাইরাল হওয়া একটি আন্দোলন ক্ষমতাশালী এবং সাধারণ নেপালীদের ভেতরকার বৈসাদৃশ্যকে প্রকট করে জনবিক্ষোভ আরো বাড়ায়।
বিশ্বব্যাঙ্কের মতে, নেপালী অর্থনীতি প্রবাসী নেপালীদের পাঠানো অর্থের উপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। নেপালের জিডিপির ৩৩.১ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশের বেশি আসে প্রবাসীদের পাঠানো ব্যক্তিগত রেমিট্যান্স থেকে এবং গত তিন দশকে এই হার স্থিরভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত সোমবার কাঠমান্ডুতে সংসদ ভবন কমপ্লেক্সের কাছে পুলিশ এবং বিক্ষোভকারীদের সঙ্ঘর্ষ হবার পর দাবানলের মত প্রতিবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
কাঠমান্ডুর ‘সিভিল সার্ভিস হাসপাতাল’-এর নির্বাহী পরিচালক মোহন রেগমির বিক্ষোভের দ্বিতীয় দিন বা মঙ্গলবারই সিএনএন-কে জানান যে অন্ততঃপক্ষে ২২ জন মানুষ নিহত হয়েছেন।
নেপালের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসমেত ৪০০-র বেশি মানুষ সোমবার হাসপাতালে ভর্তি হয়। ‘কাঠমান্ডু পোস্ট’ সংবাদপত্রের মতে, গত মঙ্গলবার পত্রিকাটির ভবনে আগুন ধরিয়ে দেওয়ায় এর অন্তর্জাল সার্ভার ডাউন হয়ে যায়।
জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিও গ্যুতেরেস মঙ্গলবারই এক্স হ্যান্ডেলে ‘পূর্ণাঙ্গ তদন্ত’ এবং ‘সহিংসতার নতুনতর বিস্তাররোধে সংযমে’র আহ্বান জানিয়েছেন। ‘আমি কর্তৃপক্ষকে মানবাধিকার আইনের সাথে সাযূজ্য রাখতে আহ্বান জানাই। প্রতিবাদ কর্মসূচীও শান্তিপূর্ণভাবে, জীবন ও সম্পদকে শ্রদ্ধার সাথে সঙ্ঘটিত হতে হবে,’ গুতেরেস বলেন।
গত মঙ্গলবার নেপালী প্রধানমন্ত্রী কে.পি.শর্মা ওলির পদত্যাগের আগেই বিক্ষোভ দমনে সরকারের ব্যর্থতা ও এত বেশি প্রাণহানির প্রেক্ষিতে সরকারী কর্মকর্তারা পদত্যাগ শুরু করেছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক সোমবারই পদত্যাগ করেন এবং এক দিন পরে কৃষি, পানি এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পরই নেপালী সেনাবাহিনী একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনার আবেদন জানায় এবং ‘এই সঙ্কটকালীন মূহুর্তে জীবন ও সম্পত্তির আর কোন ক্ষতি নিরোধে সকল নাগরিককে সংযমী হবার জন্য’ মিনতি করে। মঙ্গলবারই নেপালী রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পোড়েল ‘একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সহযোগিতা’ এবং যুব বিক্ষোভকারীদের ‘কথা বলার জন্য আসতে’ আহ্বান জানান।
নেপালে বসবাসরত জননীতি বিশ্লেষক বিনয় মিশ্র সিএনএন-কে বলেন, ‘একবার প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতি সংসদকে ডেকে সরকার গঠন করতে বলবেন।’
এই মুহূর্তে যেহেতু পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোন দলেরই নেই, আইনপ্রণেতাদের পক্ষে জেন-জি প্রজন্মের কিছু সংগঠনের সাথে মিলে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনেরই সম্ভাবনা তাই বেশি এবং জেন-জি সংগঠনের নেতারাই স্বল্পসময়ের মেয়াদে এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কে হবেন সে বিষয়ে আলোচনা করছে বলে কাঠমান্ডু ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ ম্যানেজমেন্ট-এর জননীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিনয় মিশ্র বলেন।
পদত্যাগের আগে একটি বিবৃতিতে ওলি বলেন যে তাঁর সরকার ‘জেন-জি প্রজন্মের দাবি-দাওয়ার প্রতি নেতিবাচক ছিল না’ এবং তিনি আরো বলেন যে সোমবারের ঘটনাবলীতে তিনি ‘গভীর দু:খ পেয়েছেন।’ ওলি তাঁর বিবৃতিতে ‘বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠির অনুপ্রবেশ’কে এই রক্তাক্ত সহিংসতার জন্য দায়ী করেন যদিও কারা এই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠিসমূহ, সে বিষয়ে তিনি বিশদ কিছু বলেননি।
এদিকে ১০ই সেপ্টেম্বর (বুধবার) কাঠমান্ডু থেকে শার্লট স্কারর প্রেরিত এবং লন্ডন থেকে সিমন ফ্রেসার এবং অনবারাসন ইথিরাজনের সম্পাদনায় ‘নেপাল পার্লামেন্ট সেট অন ফায়ার আফটার পিএম রিজাইনস ওভার এ্যান্টি-করাপশান প্রটেস্টস’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘সোমবার পুলিশের সাথে সঙ্ঘর্ষে ১৯ জন দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীর মৃত্যুতে জনরোষ তুঙ্গে ওঠা এবং গত কয়েক দশকে নেপালের মন্দতম বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করেছেন।
মঙ্গলবার বিক্ষুব্ধ জনতা রাজধানী কাঠমান্ডুর সংসদে আগুন ধরালে আকাশ কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। সরকারী ভবন এবং রাজনৈতিক নেতাদের বাড়িগুলো দেশ জুড়েই আক্রমণের শিকার হয়।’
মঙ্গলবার নাগাদ আরো তিনটি মৃত্যুর খবর নথিবদ্ধ হয়েছে। এই হট্টগোল ও হাঙ্গামার মধ্যে নেপালের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর দু’টো কারাগার থেকে ৯০০ অপরাধী পালাতে সক্ষম হয়েছে বলেছে জেল কর্মকর্তারা জানান।
সামাজিক মাধ্যমগুলো ব্যান করার সরকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয়। সোমবার নাগাদ এই ব্যান তুললেও ততক্ষণে বিক্ষোভ ফুলে-ফেঁপে প্রতিবাদ আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। নেপালের সেনাবাহিনী প্রধান গত মঙ্গলবার বিক্ষোভকারীদের এই বলে অভিযুক্ত করেন যে ব্যক্তিগত এবং সরকারী সম্পত্তির ধ্বংস সাধন, লুটপাট এবং অগ্নি-সংযোগের মাধ্যমে তারা বিদ্যমান অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে।
এই বিক্ষোভ বা অশান্তি চললে, ‘নেপালী সেনাবাহিনীসহ সব নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিতে বদ্ধ-পরিকর’ বলেও সেনাপ্রধান জানান। যদিও এই ‘নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা’-য় কী কী পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে, তা’ তিনি জানাননি।
প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেও এটা এখনো পরিষ্কার নয় যে তাঁর স্থলে কে পদাভিষিক্ত হবেন- অথবা সামনে কে ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছেন, যেহেতু এই মূহুর্তে কেউই দায়িত্বে নেই। মন্ত্রীরা সহ কিছু রাজনৈতিক নেতা, ইতোমধ্যেই নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে আশ্রয় নিয়েছেন।
বৃহত্তর ভাবে দুর্নীতি দমন ব্যানারের আওতায় আন্দোলন করলেও বিক্ষোভকারীরা এখনো পর্যন্ত তাদের সব দাবি-দাওয়া স্পষ্ট করেনি। এই বিক্ষোভ স্বতঃস্ফূর্ত এবং কোন সংগঠিত নেতৃত্ব নেই।
নেপালী সংসদ ভবনের ভেতরে, শত শত বিক্ষোভকারীকে নাচতে এবং ভবনের প্রবেশমুখে জ্বালানো একটি অগ্নিকুন্ডলী ঘিরে শ্লোগান দিতে দেখা যায়, অনেকের হাতেই ধরা ছিল নেপালী জাতীয় পতাকা।
কিছু বিক্ষোভকারী ভবনের ভেতর ঢোকেন, যেখানে ভবনের অধিকাংশ জানালা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। জানালাগুলোর বহির্ভাগে গ্রাফিতি এবং সরকারবিরোধী শ্লোগানগুলো রং স্প্রে করে আঁকা ও লেখা হয়েছে।
সংসদ ভবনের বাইরে বিশ বছর বয়সী মুনা শ্রেষ্ঠা সমবেত জনতার মাঝে ছিলেন।
‘দুর্নীতি বহু দিনের একটি ইস্যু,’ মুনা বলেন বিবিসি-কে, সেই সাথে আরো যোগ করেন যে ‘এটাই প্রকৃষ্ট সময় আমাদের জাতির, প্রধানমন্ত্রীর এবং ক্ষমতাসীন যে কারো বদলের, কারণ আমাদের পরিবর্তন প্রয়োজন।’
‘এটা এখন ঘটেছে এবং আমাদের আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না যেহেতু আমরা এটা প্রত্যক্ষ করেছি এবং এর জন্য লড়াই করেছি। আমি আশাবাদী যে এই বদল আমাদের জন্য কিছু ইতিবাচক বিষয়ই বয়ে আনবে।’
মুনা আরো মনে করেন যে সাধারণ মানুষের দেয়া কর দেশটির বিকাশের স্বার্থে ভাল ভাবে ব্যবহার করা উচিত।
গত সপ্তাহে, নেপাল সরকার নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর নিবন্ধীকরণ না করার দায়ে ২৬টি সামাজিক মাধ্যম অবরুদ্ধ করে দেয়। উল্লেখ্য যে ইনস্টাগ্রাম এবং ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা নেপালে কয়েক মিলিয়ন যারা বিনোদন, সংবাদ এবং ব্যবসার কাজে এই দুই মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল।
অন্যদিকে সরকার মিথ্যে খবর, ঘৃণা উক্তি এবং অন্তর্জালভিত্তিক প্রতারণা রোধে সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করার পক্ষে যুক্তি সাজিয়েছিল। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম এই পদক্ষেপগুলোকে বাক-স্বাধীনতার প্রতি আক্রমণ হিসেবে সমালোচনা করে।
যদিও গণবিক্ষোভের মুখে সোমবার রাতেই তাড়াহুড়ো করে সামাজিক মাধ্যমগুলো পুনরায় খুলে দেওয়া হয়, ততক্ষণে এই প্রতিবাদ আন্দোলন এক ‘না থামার মূহুর্তে’ পৌঁছে গেছিল যার মূল লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক অভিজাতবৃন্দ এবং গোটা জাতিকে এক প্রচন্ড বিশ্ঙ্খৃলার ভেতর ডুবিয়ে দেয়।
বিগত সরকারের এক মন্ত্রী বলেছিলেন যে সোমবার রাতেই এক বিশেষ জরুরি বৈঠকে তারা ‘জেন-জি প্রজন্মের দাবি-দাওয়াগুলো পূরণের সিদ্ধান্ত নেন।’
তবে সরকার থেকে সামাজিক মাধ্যম বন্ধের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই অন্তর্জালে ‘নেপো কিড’ প্রচারণা নামে একটি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল যেখানে রাজনীতিকদের সন্তানদের বিলাসী জীবন এবং সরকারের দুর্নীতির উপর আলো ফেলা হয়।
সোমবার হাজার হাজার তরুণ প্রথমে সংসদ ভবনে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। কয়েকটি জেলায় কার্ফ্যূ ঘোষণা করা হয়। অধিকাংশ মৃত্যুর ঘটনাই সংসদের চারপাশে এবং সরকারী ভবনগুলোর চারপাশে ঘটে।
মঙ্গলবার প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। বিক্ষুব্ধ জনতা নেপালী কংগ্রেস পার্টির মূল অফিস আগুনে জ্বালিয়ে দেয় এবং এই রাজনৈতিক দলটি বিগত সরকারের সহযোগী দল ছিল। এই দলের নেতা শের বাহাদুর দেউবার বাড়িও আগুনে পোড়ানো হয়।
চারবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত এবং নেপালী কম্যুনিস্ট পার্টির প্রধান, ৭৩-বছর বয়সী কেপি ওলির বাড়িতেও অগ্নি-সংযোগ করা হয়।
ওলি জানান যে বিদ্যমান সঙ্কট মোকাবেলায় একটি সাংবিধানিক সমাধানের পথ খুলে যাবার লক্ষ্যে তিনি পদত্যাগ করেন।
রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পোড়েলকে লেখা এক চিঠিতে ওলি বলেন, ‘দেশের এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, আমি পদত্যাগ করেছি যা আজকে থেকেই কার্যকর হবে এবং যা এই সমস্যার সমাধানে সাহায্য করবে এবং সংবিধান অনুসারে গোটা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে সাহায্য করবে।’
নেপালী রাষ্ট্রপতির এক সহায়তাকারী রয়টার্সকে জানিয়েছেন যে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন এবং ‘একজন নতুন নেতার জন্য প্রক্রিয়া এবং আলোচনার সূচনা করেছেন।’
এদিকে ১০ তারিখ বিবিসি-তে প্রকাশিত (বাংলাদেশের ১১ তারিখ সকালে এক ঘন্টা আগে প্রকাশিত হিসেবে পাওয়া) আর একটি প্রতিবেদন অনুসারে বুধবার কাঠমান্ডুর বিমান বন্দর পুনরায় খুলে গেছে এবং রাজধানী কাঠমান্ডু আজ তুলনামূলক শান্ত ছিল যেহেতু অধিকাংশ নাগরিকই কার্ফ্যূ মেনে চলছিলেন, তবে পুড়তে থাকা ভবনগুলো থেকে তখনো ধোঁয়া উড়ছিল।
নেপালী সেনাবাহিনী, যারা কিনা একটি সর্পিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে, জেন-জি প্রতিবাদকারীদের শান্তি আলোচনায় আহ্বান জানিয়েছেন। ছাত্র নেতারা তাঁদের দাবি-দাওয়ার একটি পরিচ্ছন্ন তালিকা সংহত করার চেষ্টা করছে বলে তাঁদের একজন প্রতিনিধি বিবিসি-কে বলেন।
দেশব্যপী কার্ফ্যূ বৃহষ্পতিবার সকাল পর্যন্ত থাকবে এবং সেনাবাহিনী সন্ত্রাস ও বর্বরতাকে দন্ড দেবার মর্মে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। সন্ত্রাস এবং লুট-পাটের দায়ে ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ৩১টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে।
রাজধানী শহরের সামরিক চেকপোস্টগুলোয় সেনা কর্মকর্তারা যানবাহনগুলোর আইডি পরীক্ষা করছেন এবং নাগরিকদের বাড়িতে থাকার আবেদন জানাচ্ছেন। লাউডস্পীকারে ‘অকারণে ঘোরাঘুরি করবেন না’ বলে সেনা কর্মকর্তাদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
তবু কিছু তরুণ আবর্জনা তোলার পাত্র হাতে নিয়ে এবং মুখোশ পরে বের হয়েছিলেন গত ক’দিনের বিক্ষোভ সৃষ্ট ধ্বংসস্তুপ পরিষ্কার করতে।
‘দুর্নীতি নেপালে বহু, বহু দিন ধরে ঘটছে আর আমার মনে হয় এখনি আমাদের জাতির পরিবর্তনের পক্ষে সেরা সময়,’ বলেন কসাং লামা (১৪) যে নিজে অবশ্য প্রতিবাদে অংশ নেয়নি। ‘আমি সত্যিই আশা করি যে এই বদল দেশের জন্য ইতিবাচক কিছু বয়ে আনবে।’
চব্বিশ বছর বয়সী পরশ প্রতাপ হামাল প্রতিবাদে অংশ নেননি। তিনি বিশ্বাস করেন যে নেপালের প্রয়োজন ‘স্বাধীন রাজনীতিবিদদের’ এবং কাঠমান্ডুর মেয়র বলেন্দ্র শাহ একজন ভাল নেতা হতে পারেন বলে তিনি মনে করেন।
‘এই বিপ্লবের পর মানুষ এখন আশাবাদী,’ বলেন ৩৬-বছর বয়সী রাকেশ নিরৌলা যিনি নেপালের পূর্বাঞ্চলে বসবাস করেন। ‘এখন অধিকতর সুশাসনের আশা করা যায়...মনে হচ্ছে যে নেতারা একটি শিক্ষা গ্রহণ করবেন এ থেকে যাতে তারা নিজেদের আচরণ উন্নততর করবেন এবং জাতির ভবিষ্যত যেন উজ্জ¦লতর হয়।’
তবে দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে স্বাগত জানালেও কিছু নেপালী বিবিসি-কে বলেন যে বিক্ষোভকারীরা যে মাত্রায় সন্ত্রাস এবং বর্বরতার প্রকাশ ঘটিয়েছে, তাতে তাঁরা বিষ্মিত।
‘ব্যক্তিগত ভাবে আমি বিশ্বাস করি যে এমনটা ঘটা উচিত হয়নি,’ বলেন মিস্টার নিরৌলা।
ললিতপুর শহরের অধিবাসী এবং পেশায় একজন উদ্যোক্তা প্রভাত পোড়েলের মতে সুপ্রীম কোর্টসহ বিভিন্ন সরকারী ভবন পুড়িয়ে দেওয়ায় তিনি প্রচন্ড বিচলিত বোধ করছেন যেহেতু ‘এসব ত’ আমাদেরই নিজস্ব জাতীয় সম্পদ।’
তবে সেনাবাহিনীর সুরে সুর মিলিয়ে অনেক প্রতিবাদকারীও বলছেন যে এই আন্দোলনে বহু ‘স্বার্থান্বেষী অনুপ্রবেশকারীরাও’ ঢুকে পড়েছে।
‘আমরা সেই সব সমাজবিরোধীদের নিয়ন্ত্রণ করার প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত যারা এই বিশেষ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে লুটপাট ও অগ্নি-সংযোগে ব্যস্ত এবং নানা ঘটনা ঘটাচ্ছে,’ সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রাজারাম বাসনেত বিবিসি-কে বলেন। এদিকে প্রতিবাদকারীদের এক বিবৃতিতে বলা হয় যে এই আন্দোলন ‘অহিংস ছিল এবং রয়েছে এবং শান্তিপূর্ণ নাগরিক সম্পৃক্ততাতেই আমাদের শেকড় প্রোথিত।’ গোটা পরিস্থিতির ‘ব্যবস্থাপনা দায়িত্বের সাথে পরিচালনা,’ নাগরিকদের সুরক্ষা প্রদান এবং জনসম্পত্তি রক্ষাও তাদের লক্ষ্য বলে তারা জানান। বুধবার থেকে আর কোন প্রতিবাদ কর্মসূচী দেয়া হবে না এবং সামরিক বাহিনী ও পুলিশ প্রয়োজনে কার্ফ্যূ বাস্তবায়ন করতে পারবে বলেও তারা উল্লেখ করেন।
তবে প্রতিবাদকারীদের এই আপাতঃ ঘোষণা সত্ত্বেও বুধবার সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃপক্ষ আদালত ভবনের তীব্র ক্ষতির কারণে অসমাপ্ত মামলাগুলোর সব শুনানি আপাততঃ বাতিল ঘোষণা করেছে এবং সরকারী ভবনগুলোর এক বিশাল কমপ্লেক্স ‘সিংহ দরবার’ এই দিনেই তছনছ করা হয়।
এদিকে মঙ্গলবারই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঝালনাথ খানালের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলে তাঁর স্ত্রী রবিলক্ষী চিত্রকর ভয়ানক ভাবে দগ্ধ হন। কিছু সংবাদ মাধ্যমে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হলেও তাঁর স্বামী ‘নেপালী বিবিসি’-কে বলেছেন যে রাজধানীর ’কীর্তিপুর বার্নস হসপিটাল’-এ তিনি আইসিইউ-য়ে খুবই সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আছেন। অগ্নিদগ্ধ হবার পর পাশের বাড়ি থেকে মইয়ে করে উদ্ধারকারীরা তাঁকে উদ্ধার করেন।
মঙ্গলবার নেপালের পশ্চিমাঞ্চলের বাঙ্কেতে একটি কিশোর অপরাধী সংশোধনাগার থেকে পালানোর সময় নিরাপত্তা বাহিনী গুলি ছুঁড়লে পাঁচ জন অল্পবয়সী কিশোর নিহত হয়। এদের প্রত্যেকেরই বয়স আঠারোর নিচে ছিল বলে এক কারা পরিচালক জানান।
প্রধানমন্ত্রী ওলির পদত্যাগের পর থেকে নেপালে এই মূহুর্তে বিরাজ করছে এক ধরণের শূন্যতা। ‘সামনের দিকে তাকিয়ে, আমরা বিশ্বাস করি যে নেপালের আগামী দিনের নেতৃত্ব কট্টর দলীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হয়ে পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন হবে এবং দক্ষতা, সততা এবং যোগ্যতা দ্বারা পরিচালিত হবে,’ জেন-জি প্রতিবাদকারীরা একটি বিবৃতিতে বলেন।
‘আমরা একটি স্বচ্ছ ও স্থিতিশীল সরকারের প্রত্যাশা করি যারা জনতার স্বার্থে কাজ করবে এবং দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তি বা রাজনৈতিক অভিজাতদের স্বার্থে কাজ করবেনা।’
কাঠমান্ডুর ৪০-বছর বয়সী সমাজকর্মী তরু কার্কিও তাই মনে করেন, ‘আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যেহেতু নিষ্পাপ তরুণেরা মারা গেছে,’ তিনি বলেন এবং হতাশায় এত এত মানুষের রাস্তায় নেমে আসার পর দেশে এখন দূর্নীতির অবসান হওয়া উচিত এবং দেশের প্রয়োজন শান্তি।
‘যথেষ্ট হয়েছে,’ তিনি বলেন।
সিএনএন-এর একটি এবং বিবিসি-র দু’টো প্রতিবেদনের দীর্ঘ অনুবাদ ও উদ্ধৃতির পর এবার রুশ সংবাদমাধ্যম বি-৯২-এর ১০ তারিখের সংবাদ (বাংলাদেশে ১২ তারিখ সকালে পাওয়া) একটি প্রতিবেদন ‘ক্যাওস ইন নেপাল: কালার রেভল্যুশনস বিকাম ইন্টারনেট রেভল্যুশনস; ব্লাডি ফিস্টস আর এ্যান অমিনাস সাইন’ থেকে নিচে অনুবাদ করা হলো।
দুর্নীতি-বিরোধী দু’দিন ব্যপী বিক্ষোভ যার ফলে ২১ জন নিহত হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী কে.পি.শর্মা ওলি পদত্যাগ করেছেন, তারপর আজও কাঠমান্ডুতে কার্ফ্যূ চলা অবস্থায় নেপালী সেনাবাহিনীর টহল অব্যাহত রয়েছে যার শেষ কবে হবে কেউ জানে না।’
‘সবার আগে যেটা বলতে চাই যে আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। আমরা জনগণের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় নিবেদিত,’ সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রাজা রাম বাসনেত গণমাধ্যমকে একথা বলেন।
কাঠমান্ডুতে কোন বিক্ষোভ না হলেও, স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানায় যে রাজধানীর উপকণ্ঠে জনা পঁচিশেক মানুষ ‘ঝামেলা সৃষ্টি’র চেষ্টা করছিল।
‘এখন এখানে কোন প্রতিবাদ নেই। রাস্তায় অল্প কিছু মানুষ হাঁটছে। এখানে সব কিছু শান্ত,’ রয়টার্সকে বলেন শহরের এক অধিবাসী রাম কুমার শ্রেষ্ঠ।
নেপালী গণমাধ্যমের মতে, কর্তৃপক্ষ এবং বিক্ষোভকারীদের ভেতর সংলাপের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে, তবে বিস্তারিত কিছু এখনো জানা যায়নি।
বিদ্যমান জেন-জি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে নেপালের রাষ্ট্রপতি রাম চন্দ্র পোড়েল মঙ্গলবার প্রতিবাদী নাগরিক সহ সব রাজনৈতিক দলকে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজার লক্ষ্যে আহ্বান জানিয়েছেন।
নেপালে সহিংস বিক্ষোভের দিনগুলোয় নিরাপত্তা বাহিনী দেশটির সংসদ ভবনের কাছে বিক্ষোভরত জনতার দিকে গুলি ছুঁড়লে ২১ জন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হবার সময় এই আহ্বান জানানো হয়।
প্রতিবাদকারীরা পরবর্তীতে প্রধান সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় হামলা চালায় যার ভেতর রাষ্ট্রপতি ভবন ‘শীতল নিবাস’-ও ছিল এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ঝালানাথ খানালের স্ত্রী তাঁর বাড়িতে অগ্নি-সংযোগ হলে আগুনে পুড়ে মারা যান।
আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, বিক্ষোভকারীদের কাছে অস্ত্র সমর্পণের পরও তিন জন পুলিশকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।
ইতোপূর্বে নেপালী সেনাবাহিনী নাগরিকদের এবং বিশেষতঃ তরুণদের কাছে সংযমী হবার এবং এই অশান্ত মূহুর্তে জাতির ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার আবেদন জানায়।
‘রক্তাক্ত মুষ্টি’ একটি প্রতীক যার উপর সার্বিয়ায় বিক্ষোভ অবরোধকারীরা জোর দিয়েছিল, এবং বাংলাদেশ এবং এমনকি ক্যাপিটল হিলেও প্রতিবাদের সময় তা’ দেখা গেছে, নেপালেও যথারীতি তার ব্যত্যয় ঘটেনি। রক্তাক্ত মুষ্টি, যা বিশৃঙ্খলা, হিসাব-নিকাশ চোকানো এবং গৃহযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, কাঠমান্ডু দাঙ্গাতেও ব্যবহৃত ও চিত্রায়িত হলো।
এই নির্দিষ্ট প্রতীকটি সুস্পষ্টভাবে সেই একই রেসিপির ইঙ্গিত করে যা এতটুকু অদল-বদল ছাড়াই পৃথিবীর সব প্রান্তেই ‘রঙিন বিপ্লব’ ঘটাতে এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করতে ব্যবহার করা হয়।
ইলিয়া স্পেকতর, মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির ‘এশিয়ান এ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বলেন: ‘যদি আপনি সত্যিই মনে করেন যে, একটি দেশ যেখানে নাগরিকদের গড় বয়স ২৫, এবং তরুণদের ভেতর বেকারত্বের হার সরকারী হিসেব মতেই ২০% শতাংশ (বাস্তবে আরো বেশি) এবং মাথা পিছু গড় আয় ভারতের মাথা পিছু আয়ের অর্ধেক, সেখানে ইউটিউব বন্ধ করায় তরুণেরা রাস্তায় নেমেছে- তবে আপনার বিশ্বদর্শন খুবই আশ্চর্যজনক। হ্যাঁ, সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করাটা ছিল শেষ কাজ, সরকার নিজেই নিজের পায়ে এর মাধ্যমে গুলি করেছে, তবে নেপালের রাজনৈতিক সঙ্কট এর চেয়েও অনেক ভয়াবহ।’
‘স্পষ্টতঃ এটি নেপাল প্রজাতন্ত্রের গত ১৭ বছরের অস্তিত্বে সবচেয়ে ভয়াবহ সঙ্কট। বিক্ষোভকারীরা সংসদে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল- উভয়ের প্রতি সমান মাত্রায় তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছে- যদিও শাসক দল একাই এত দিন সংসদে ক্ষমতায় ছিল। এই বছরের শুরুতে, বিক্ষোভকারীরা রাজতন্ত্রের ফিরে আসা চেয়ে শ্লোগান দিয়েছে- এবং সেই দৃশ্য সহজে ভোলা যায় না,’ ইলিয়া বলেন।
‘ইতিমধ্যে, ভারতীয় ভাষায় কথা বলা ব্লগাররা এই আন্দোলনকে বিপুল সমর্থন দিচ্ছে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক নিকোলাই স্তারিকভ বলেন: ‘এখানে আপনার যা জানা দরকার তা’ হলো নেপালের ‘ময়দান’: মানচিত্রের দিকে তাকান। তারপর এই অশান্তির তথাকথিত কারণগুলো পড়ুন- সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করা। অথচ, সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোর নিবন্ধীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় আইন পাশ হয়েছিল দু’বছর আগে।’
‘এখন, স্মরণ করুন নেপাল কোথায় অবস্থিত- ভারত ও চীনের ভেতর। মাত্র এক সপ্তাহ আগে, নয়া দিল্লি এবং বেইজিং পুনর্মিলিত হয়েছে এবং পরষ্পর কাছে এসেছে। এবং হুট করেই, নেপালে দাঙ্গা শুরু হলো। খাঁটি ইউক্রেনীয় পদ্ধতিতে অভ্যুত্থান যাকে বলে! জনতা হামলা করছে সংসদে, পুলিশ জলকামান ও রাবার বুলেট দিয়ে প্রত্যুত্তর দিচ্ছে। এবং কীভাবে কীভাবে আমরা এর ভেতরেই এত হতাহতের সংখ্যা জানছি।’
‘দাঙ্গাকারীদের শ্লোগান? ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে।’ সামনে তাকালে আপনি দেখবেন স্কুলের বাচ্চা এবং ছাত্রদের- ‘ওরা নিছকই বাচ্চা’-র সেই বিখ্যাত গল্প। আমি এর ভেতর দেখতে পাই এক ধূরন্ধর কৌশলীর কাজ। একটি ধ্রুপদী কর্ম।’
‘নেপালে আমরা যা দেখছি তা’ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নানা বৈপরীত্য যেন একটি প্রেশার কুকারে থেকে শেষপর্যন্ত সেদ্ধ হয়ে শব্দ করেছে। সেটাই মূল কারণ। সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করার সরকারী সিদ্ধান্ত প্রেশার কুকারের অ্যালার্ম বাজিয়েছে। সেই অর্থে আমি বরং বলব যে আমরা একটি রূপান্তরের সাক্ষী হচ্ছি: আগে যাকে ‘রঙিন বিপ্লব’ বলা হতো, তা’ ক্রমাগত হয়ে উঠছে অন্তর্জাল বিপ্লব।’
‘এটা সম্পূর্ণতঃ সম্ভব যে পৃথিবীতে আগামীর অভ্যুত্থানগুলোও অন্তর্জালিক কর্মকান্ড দিয়েই চালিত হবে,’ কতকভ আরো বলেন।
‘একথা বলার পাশাপাশি, এটাও উল্লেখ করতে চাই যে নেপালী বিপ্লবের সঠিক প্রকৃতি বিচারের এখনি সময় আসেনি। নতুন সরকার এখনো গঠন হয়নি এবং আমরা জানিনা যে সাধারণ জনতাকে প্রতিবাদকারী নেতারা কি দেবেন।’
২০০৩ সালে আলবেনিয়ায় এই একই কোরিওগ্রাফি দেখা গেছে, যেখানে একটি এনজিও ‘মজাফত’ (এর অর্থ ’যথেষ্ট’) সেদেশে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছিল। এই সংগঠনটি মার্কিনী অর্থে সাহায্যপুষ্ট ও সক্রিয় ছিল এবং ‘রক্তাক্ত মুষ্টি’র প্রতীক খুব দ্রুতই সেদেশের গোটা ব্যবস্থা এবং দেশটিই ভেঙ্গে ফেলার আকাঙ্খার প্রতীকে পরিণত হলো, যা বিদেশী স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণও বটে।
মার্কিনী গণমাধ্যম ‘ফক্স নিউজ’ কয়েক বছর আগে প্রাক্তন আলবেনীয় রাষ্ট্রপতি ইলির মেটার একটি বিবৃতি প্রসঙ্গে মন্তব্য করে যেখানে ইলির জর্জ সোরোসকে তাঁর দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।
‘বিডি ভয়েস’ একটি নতুন তবে নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম হিসেবে বৃটিশ, মার্কিনী সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি একটি রুশ সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনও এই প্রবন্ধে অনুবাদ ও উদ্ধৃত করেছে। শ্রীলঙ্কার পর বাংলাদেশ হয়ে নেপালে যে ‘অভ্যুত্থান’ হলো, তার পেছনে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও দুর্নীতি, সাধারণ মানুষের বেকারত্ব ও দারিদ্র্য যেমন আছে, কিন্তু ‘অভ্যুত্থান’ হলেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে? অনেক রক্ত ও ক্ষয়ক্ষতির পর যে পরিবর্তনসমূহ আসছে বা আসবে, তাতে কি সাধারণ মানুষের বাস্তবিকই মোক্ষ লাভ হতে চলেছে? তার যাবতীয় সংগ্রাম ও কষ্টের অবসান হয়ে স্বর্গরাজ্য স্থাপিত হচ্ছে কী? স্বর্গরাজ্য না হোক, উন্নততর বা শ্রেয়তর কিছু কি হচ্ছে? নাকি পরিস্থিতি আরো শোচনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে? ঠিক বাংলাদেশের মতই নেপালেও রাতারাতি এত মানুষের এত দ্রুত মৃত্যু, আন্দোলনে র্যাপার ও টিকটকারদের তথা অন্তর্জালের প্রাধান্য, অগ্নি-সংযোগ ও লুটপাটসহ নানাবিধ নৃশংসতা, সংবিধান বদলের দাবি- আমরা শুধুই অসহায় হয়ে দেখে যাচ্ছি।