বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও নৃত্যের শিক্ষক নিয়োগ এইটুকু খবর শুনে দেশের কিছু মহৎ ভণ্ড আলেম যেন হাঁটুতে বাতাস পেয়ে গেলেন। তারা মিছিল ডাকলেন, সমাবেশ করলেন, আর ঘোষণা দিলেন “নাচ-গান মানেই নাস্তিক্যবাদ!” মনে হলো যেন হারমোনিয়াম বাজলেই ঈমান হাওয়ায় উড়ে যাবে, আর ঢোলের শব্দে বেহেশতের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই মহৎ মানুষগুলো যখন মাদ্রাসার শিশুদের ওপর নির্যাতনের খবর শিরোনামে আসে, তখন তাদের গলা বসে যায়। শতশত মাদ্রাসায় ছাত্রদের বলৎকার, ছাত্রীদের শারীরিক শোষণ, অর্থ আত্মসাৎ-এসব নিয়ে তারা মুখ খোলেন না। যেন এসব কিছুই ইসলামের পরিপন্থী নয়! কিন্তু বেচারা “সা-রে-গা-মা”- এটাই নাকি সবচেয়ে বড় গুনাহ।
কিন্তু ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। ইসলামী সভ্যতার সোনালি যুগে সংগীত, সাহিত্য, স্থাপত্য ও দর্শন ছিল আধ্যাত্মিক সাধনারই অংশ। সুফিদের দরবেশি আসরে ভজন, কাওয়ালি বা সুরের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেছে। পৃথিবীর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যেমন মিশর, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়া তারা আজও স্কুল পর্যায়ে সংগীত শিক্ষা বজায় রেখেছে। তাহলে বাংলাদেশে সংগীত কেন হঠাৎ “নাস্তিক্যবাদী ষড়যন্ত্র”হয়ে উঠল? উত্তর খুব সহজ । এটা সংস্কৃতি নয়, এটা ধর্মের নামে ক্ষমতার রাজনীতি।
আপন ঐতিহ্যে ফিরে তাকালে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। এই বাংলায় লালন সাঁই গান গেয়েছেন “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”, হাসন রাজা গেয়েছেন মানবতার কথা, নজরুল গেয়েছেন শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মিছিলে “আমার সোনার বাংলা” গাইতে গাইতেই তো লাখো মানুষ জীবন দিয়েছে। আজ যারা গানকে অপসংস্কৃতি’র নামে ভারতের সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দিতে চায় তাদের ধর্মীয় ভণ্ডামি ইতিহাস হয়ে থাকবে।
তারা বলে সংগীতের কোনো দরকার নেই, দরকার শুধু পড়ালেখা আর ধর্ম। অথচ ইসলামের ইতিহাসে কত মহান মানুষ সংগীতচর্চা করেছেন, তবুও ছিলেন ধার্মিক। ইশাক আল-মাওসুলি ছিলেন বাগদাদের আব্বাসীয় আমলে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ ও সঙ্গীততত্ত্ববিদ। তাঁকে আরব সঙ্গীত ঐতিহ্যের অন্যতম প্রবর্তক ধরা হয়। আল-কিন্দি ছিলেন ইসলামের প্রথম দিকের দার্শনিক ও বিজ্ঞানী, যিনি সঙ্গীতকে গণিত ও জ্যামিতির সঙ্গে যুক্ত করে দেখান। আবু নসর আল-ফারাবি ছিলেন মহান দার্শনিক ও সঙ্গীত তত্ত্ববিদ। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “কিতাব আল-মুসিকা আল-কবীর” সঙ্গীততত্ত্বের এক অসাধারণ কাজ। সাফি আল-দিন আল-উরমাভি ফারসি সঙ্গীত তত্ত্ববিদ, যিনি সঙ্গীত লিপি উন্নয়ন করেছিলেন। তাঁর গ্রন্থ “কিতাব আল-আদওয়ার” ইসলামি সঙ্গীততত্ত্বের অন্যতম প্রধান দলিল।
ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে বহু প্রখ্যাত সঙ্গীত-বিশারদ, গায়ক ও তত্ত্ববিদ জন্ম নিয়েছেন, যাঁরা হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও সুফি সঙ্গীতকে নতুন রূপ দিয়েছেন। ইসলামি সভ্যতার ধারার সঙ্গে মিশে ভারতীয় রাগ-রাগিনী ও আধ্যাত্মিক সঙ্গীত বিকাশ লাভ করেছে।
দিল্লির সুলতানি আমলের কবি, সুফি ও সঙ্গীতজ্ঞ আমির খসরু। তাঁকে ভারতীয় মুসলিম সঙ্গীতের জনক বলা হয়। খেয়াল, কাওয়ালি প্রবর্তনের কৃতিত্ব তাঁর। সম্রাট আকবরের দরবারের নবরত্নদের একজন ছিলেন তানসেন। তিনি বহু রাগ সৃষ্টি করেছেন বলে জনশ্রুতি আছে। বাজ বাহাদুর ও রূপমতী তাঁদের যুগল গানের কাহিনি আজও কিংবদন্তি। ওস্তাদ আল্লাদিয়া খান, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান, নুসরাত ফতেহ আলি খান, আরও আছে বিসমিল্লাহ খান এর পাগলা সানাই। লোকমুখে বলা হতো, তাঁর সানাইয়ের সুরে ভক্তরা যেমন মুগ্ধ হতো, তিনিও তেমনভাবে বাজনার ভেতর পাগল হয়ে যেতেন। তাই তাঁকে অনেকে ভালোবেসে বলতেন—পাগলা সানাই। আর এদেশের বিজ্ঞানী, কবি, শিল্পী অসংখ্য নামই প্রমাণ দেয়, গান মানুষকে পাপী নয় বরং আরও মানবিক করে তোলে।
ভুলে গেলে চলবে না, বাংলার মানুষ হাজার বছর ধরে গান গেয়ে এসেছে। কৃষকের মাঠে ধান কাটার গান, নৌকোয় ভাটিয়ালি, বিয়ের ঘরে গীত, কিংবা লালন-হাসন-নজরুলের গান - এসবই আমাদের রক্তে মিশে আছে। বাংলার মানুষ কবিমনা, গানমনা। অশিক্ষিত কৃষকও সুরে সুরে কবিতা লিখে ফেলতে পারে। পৃথিবীর আর কোথায় এমন ঐতিহ্য আছে? এখন যদি সংগীত শেখানোকে “অপরাধ” বলে ঘোষণা করা হয়, তবে আমাদের সন্তানরা কি এ ঐতিহ্য থেকে বঞ্চিত হবে না?
কিন্তু ভণ্ড আলেমদের আসল সমস্যা অন্য জায়গায়। তারা ভয় পান শিশু যদি গান শেখে, নাচ শেখে, তবে সে মুক্ত চিন্তা করবে, প্রশ্ন করবে। আর প্রশ্ন করলেই তাদের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। তাই তারা ঢোল পেটাচ্ছেন - “সংগীত মানেই অপসংস্কৃতি!” অথচ নিজের ঘরে তারা দিব্যি বিদেশি সিনেমা দেখে, ইউটিউবে নাচের ভিডিও দেখে, পর্ণ তারকা মিয়া খলিফার খোঁজ ঠিকই রাখে। কিন্তু প্রকাশ্যে এসে ভণ্ডামির ঢোল বাজায়। কারণ বিভক্ত, সংস্কৃতিবিহীন, ভয়ভীতিতে আচ্ছন্ন সমাজই তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার নিরাপদ জায়গা।
বাংলাদেশ তাদের মতো ভণ্ড আলেমদের হাতে কতটা নিরাপদ? তারা চায় একটি অন্ধকার সমাজ- যেখানে শিশুরা বাদ্যযন্ত্র ধরবে না, কণ্ঠে গান উঠবে না এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত প্রশস্তচেতনার বদলে ভয়ে ঢেকে যাবে। অথচ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল সেই ভয়ভঙ্গ করার লড়াই ছিল; মুক্তিযুদ্ধে গড়া দেশের লক্ষ্য ছিল একটি প্রগতিশীল, মুক্তচিন্তা ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ জাতি গঠন।
প্রগতিশীল স্বপ্নকে যদি কুচক্রী ও স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিরা ধর্মের আড়ালে হাতিয়ার করে নেন, তাহলে বাংলাদেশ শুধুমাত্র সাংস্কৃতিকভাবে পিছিয়ে যাবে না- আমরা বহু দশক এগোনোর সুযোগ হারাব। এসব ভণ্ডের দাবি মেনে নিয়ে যদি আমরা দেশের জনজীবন ও শিক্ষার ক্ষেত্র থেকে সৃজনশীলতা ও চেতনা কমিয়ে দিই, তা হবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ও ত্যাগের অবমাননা।
অতএব স্বল্পবুদ্ধি ও ভাঙা-গড়া ধর্মীয় বিধির নামে মুক্ততার অর্জন বিসর্জন দেয়া যেমন চলবে না - তেমনি আমাদের দায়িত্ব হলো মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ রক্ষা করা, স্বাধীন চিন্তা ও সৃষ্টিশীলতাকে সমুন্নত রাখা এবং আগামী প্রজন্মকে ভয় নয়, মানবিকতা ও জ্ঞানচর্চায় উৎসাহিত করা।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমরা কোন পথ বেছে নেব তার ওপর। সংস্কৃতি ও মানবতার আলোকিত পথ, নাকি মৌলবাদের ভণ্ডামি ও অন্ধকার পথ? যদি আমরা আপন সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরি, তবে বাংলাদেশ হবে মানবিক ও প্রগতিশীল। আর যদি ভণ্ড মৌলবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করি, তবে এই দেশ আর আমাদের মুক্তির বাংলাদেশ থাকবে না বরং তাদের অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যাবে।