সর্বশেষ

হামলা–হত্যার মহড়ায় দেশ

প্রশাসনিক নির্লিপ্ততা যেন সহিংসতার নীরব লাইসেন্স

প্রকাশিত: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪:১৭
প্রশাসনিক নির্লিপ্ততা যেন সহিংসতার নীরব লাইসেন্স

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বাস্তবতায় একের পর এক হামলা, হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা কেবল বিচ্ছিন্ন অপরাধ হিসেবে দেখার সুযোগ আর নেই। ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের পর গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক হামলা, ময়মনসিংহে হিন্দু যুবক দীপু চন্দ্র দাসকে গাছে বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা, লক্ষ্মীপুরে ঘরের ভেতর আগুনে সাত বছরের শিশুর মৃত্যুর ঘটনাগুলো গত ১৬ মাস ধরে চলমান গভীর রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার দিকেই ইঙ্গিত করে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক প্রশ্নটি হলো: এসব ঘটনা ঘটার আগে ও পরে প্রশাসন এতটা নিষ্ক্রিয় বা ‘নির্লিপ্ত’ কেন?

 

অপরাধ দমনে রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো প্রতিরোধ। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই হামলার ঘোষণা আগেভাগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়িয়েছে, তবুও পুলিশ বা প্রশাসনের কার্যকর উপস্থিতি ছিল না। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলার আগের রাতেই শাহবাগে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, ছায়ানট ও উদীচীতে হামলার হুমকি প্রকাশ্য ছিল- তারপরও কেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হলো না, সেই প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব আজও নেই।

 

প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘আগের মতো পুলিশিং’ আর হচ্ছে না। লাঠিচার্জ কিংবা শক্তি প্রয়োগ সীমিত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রয়োজন সাপেক্ষে শক্তি প্রয়োগ কিংবা তার পূর্বে প্রতিরোধমূলক গোয়েন্দা তৎপরতা, ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পুলিশ মোতায়েন, দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃশ্যমান জবাবদিহি এসব তো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বাভাবিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। এখানে ব্যর্থতা সিদ্ধান্ত ও সদিচ্ছার। কিন্তু প্রশ্ন হলো অন্তর্বর্তী সরকার কেন পুলিশকে এমন অকার্যকর করে রেখেছে? কার স্বার্থ এতে সংরক্ষিত হয়?

 

ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাস হত্যাকাণ্ড এই ব্যর্থতার সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরণ। ধর্ম অবমাননার মিথ্যে অভিযোগ এনে একজন মানুষকে পিটিয়ে, গাছে বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো। এটি নিছক ‘গণপিটুনি’ নয়; এটি সংগঠিত নিষ্ঠুরতা। ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে, অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে তবু প্রশ্ন থেকে যায়, এমন একটি জনবহুল এলাকায় এই নৃশংসতা চলাকালে প্রশাসন কোথায় ছিল? এখন তো জানা যাচ্ছে যে দীপু পুলিশের আশ্রয়ে ছিল, সেখান থেকে তাকে উন্মত্ত সন্ত্রাসের হাতে উঠিয়ে দেয় হয়। এই ব্যর্থতা কেবল আইনশৃঙ্খলার নয়, সংখ্যালঘু সুরক্ষায় রাষ্ট্রের দায় অস্বীকারের শামিল। সেই পুলিশ কর্মকর্তার জবাবদিহি কি অন্তর্বর্তী সরকার করবে?

 

লক্ষ্মীপুরে আগুনে পুড়ে শিশুর মৃত্যুও একইভাবে রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তাকে সামনে আনে। দরজা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ অবস্থায় আগুন লাগানোর অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে এটি পরিকল্পিত হত্যাচেষ্টা। অথচ পুলিশ বলছে, তারা ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ পায়নি। প্রশ্ন হলো, তদন্তের মান ও গতি কি আদৌ ভুক্তভোগীদের আস্থা জোগাতে পারছে?

 

গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলার বিষয়টি আরও গভীর উদ্বেগের। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট, উদীচীর মতো প্রতিষ্ঠান কেবল ইট-পাথরের ভবন নয়; এগুলো মতপ্রকাশ, সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতীক। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত যখন বলেন, এসব হামলা গণতন্ত্রের ওপর আঘাত তখন তা কেবল কূটনৈতিক মন্তব্য নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক সতর্কবার্তা। রাষ্ট্র যদি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ‘নতুন বাংলাদেশ’ কথাটি ফাঁপা স্লোগানে পরিণত হয়।

 

সরকার বলছে, কিছু গ্রেপ্তার হয়েছে, আরও শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে, গ্রেপ্তারই শেষ কথা নয়, বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই আসল। গত ১৬ মাস ধরে বারবার দেখা গেছে, বড় ঘটনার পর সরকারের তেমন কোনো হেলদোল হয়নি, বরং ‘প্রেশার গ্রুপ’ নাম দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছে। কখনো কখনো ‘জনরোষ’ নাম দিয়ে সম্মতি উৎপাদন করা হয়েছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারপর বিষয়টি ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যাওয়ায় অপরাধীরা সাহস পেয়েছে, আর ভুক্তভোগীরা হারিয়েছে আস্থা।

 

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠতেই পারে যে এগুলো কি কেবল প্রশাসনিক অদক্ষতা, নাকি রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দ্বিধা? সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে গেলে কিছু সংগঠিত গোষ্ঠীর অসন্তোষ তৈরি হতে পারে এই আশঙ্কা থেকেই কি সরকার ‘নিরপেক্ষ দর্শক’ হয়ে থাকছে? যদি তাই হয়, তবে সেটি ভয়ংকর দৃষ্টান্ত। কারণ রাষ্ট্র যখন দুর্বলতা দেখায়, তখন সহিংস শক্তিই শূন্যস্থান দখল করে।

 

এখন প্রয়োজন শুধু বিবৃতি বা আশ্বাস নয়, বরং দৃশ্যমান ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ। স্বাধীন তদন্ত, দ্রুত বিচার, প্রশাসনিক জবাবদিহি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—আগাম প্রতিরোধের সক্ষমতা। অন্যথায় একের পর এক হামলা ও হত্যাকাণ্ড কেবল বাড়তেই থাকবে, আর প্রশ্নটি আরও তীব্র হবেঃ প্রশাসন নির্লিপ্ত কেন?

সব খবর