বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য দায়িত্ব সরকারগুলো (ভূতপূর্ব তত্ত্বাবধায়ক সরকার) সাধারণত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, অবাধ নির্বাচন এবং নাগরিক স্বাধীনতা সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশা ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা ক্রমশ সেই প্রত্যাশার বিপরীত চিত্রই তুলে ধরছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একের পর এক সাংবাদিক গ্রেফতার, রিমান্ড ও কারাবন্দিত্ব স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনাকে অপরাধে পরিণত করার একটি নতুন কৌশল গড়ে উঠছে। সিনিয়র সাংবাদিক আনিস আলমগীরের গ্রেফতার ও পাঁচ দিনের রিমান্ড সেই প্রবণতার সবচেয়ে আলোচিত ও সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট পর্যন্ত এটিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবু সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো আত্মসমালোচনা বা সংশোধনের ইঙ্গিত দেখা যায়নি।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন মূলত জঙ্গিবাদ, সহিংস উগ্রবাদ ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য প্রকৃত হুমকি মোকাবিলার উদ্দেশ্যে প্রণীত। কিন্তু একজন সাংবাদিকের টকশো বক্তব্য, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ কিংবা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করাকে যদি ‘সন্ত্রাসে উসকানি’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, তবে সেই আইন কার্যত মতপ্রকাশ দমনের হাতিয়ারে পরিণত হয়। এটি শুধু আইনের অপব্যবহার নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভয়ংকর বিকৃতি।
আনিস আলমগীর একা নন। জাতীয় প্রেসক্লাবের পাঁচবারের সভাপতি শওকত মাহমুদ, স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিক মেহেদী হাসান কিংবা কিছুদিন আগে গ্রেফতার হওয়া মঞ্জুরুল আলম পান্নার ঘটনাগুলো মিলিয়ে দেখলে একটি ধারাবাহিকতা স্পষ্ট হয়। অভিযোগের ধরন ভিন্ন হলেও আইনি অস্ত্র একই—সন্ত্রাসবিরোধী আইন। এর শাস্তি কঠোর, জামিন প্রত্যাখ্যাত এবং বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ। ফলে এই আইনের প্রয়োগ নিজেই শাস্তিতে পরিণত হয়, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের পরিপন্থী।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো বহুল সমালোচিত আইন সরিয়ে দেওয়ার কথা বলে সরকার যে আশা তৈরি করেছিল, বাস্তবে তা পূরণ হয়নি। বরং সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে আরও কঠোর ও ভয়াবহ একটি আইন। মানবাধিকারকর্মীরা যথার্থই প্রশ্ন তুলছেন যে এটি কি কেবলই আইনের নাম পরিবর্তন করে দমননীতির আধিক্য বরং?
ড. ইউনূস বিশ্বময় পরিচিত একজন ‘মানবাধিকারকামী’ ও নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব। তার নেতৃত্বে সরকার সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধের পথে হাঁটবে এমন আশঙ্কা অনেকের কাছেই অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তার সরকারের সময়েই আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে অনবরত বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে হচ্ছে। এটি শুধু বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য নয়, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্যও অশনিসংকেত।
গণমাধ্যম কোনো সরকারের শত্রু নয়; বরং এটি রাষ্ট্রের আয়না। সেই আয়নায় যদি শাসকের অস্বস্তিকর প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, তবে আয়না ভাঙা সমাধান হতে পারে না। সাংবাদিকদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অভিযুক্ত করা মানে কার্যত তাদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করা যা পেশাগতভাবে অসম্মানজনক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপজ্জনক বার্তা বহন করে।
সাধারণত একটি অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য দায়িত্ব পাওয়া সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। কিন্তু সাংবাদিকদের গ্রেফতার, রিমান্ড ও হয়রানি সেই বিশ্বাস ভাঙছে। আজ যদি সাংবাদিকদের কণ্ঠ স্তব্ধ করা হয়, আগামীকাল সেই নীরবতা পুরো সমাজকে গ্রাস করবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যেখানে সংবাদমাধ্যম বন্দি, সেখানে গণতন্ত্র দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সামনে এখনো সুযোগ আছে পথ পরিবর্তনের। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ করা, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহার করা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মতো পদক্ষেপগুলোই পারে পরিস্থিতি সামাল দিতে। অন্যথায়, এই সরকার ইতিহাসে স্মরণীয় হবে একটি প্রচন্ড দমনমূলক আক্ষরিক অর্থে সর্বৈব ‘ফ্যাসিবাদি’ অধ্যায় হিসেবে।