সর্বশেষ

মতামত

“পাকিস্তানি মন্ত্রী ইসহাক দারের সাথে আমি শতভাগ একমত”

প্রকাশিত: ২৫ অগাস্ট ২০২৫, ০২:৫৬
“পাকিস্তানি মন্ত্রী ইসহাক দারের সাথে আমি শতভাগ একমত”

ভাই ও বোনেরা,
আজ আমি শুরু করতে চাই এক শত্রুর কথা দিয়ে। শত্রুর মুখ থেকেই মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসে খাটি সত্য। পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার আজ বলেছেন, ‘বাঙালির হৃদয় পরিষ্কার করতে হবে।’

 

হ্যাঁ, আপনারা অবাক হবেন, কিন্তু আমি শতভাগ একমত এই কথার সঙ্গে। কারণ সত্যিই আমাদের হৃদয় আজ ময়লায় ভরা। কিন্তু বন্ধুগণ, প্রশ্ন হলো—কোন ময়লা?
এটা কি দেহের ধুলোবালি, নাকি ঘরের আবর্জনা? না, এর কোনোটাই নয়। এই ময়লা হচ্ছে আমাদের মগজে, মননে, আচরণে জমে থাকা অন্ধকারের বিষাক্ত আস্তরণ।

 

এই ময়লাই আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে আমাদের রক্তাক্ত ইতিহাস। ভুলিয়ে দিয়েছে ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্মদান। ভুলিয়ে দিয়েছে অগণিত মা-বোনের আর্তনাদ ও আত্মত্যাগ। সেই ময়লার আস্তরণ এতটাই ঘন যে আজ আমরা নিজেদের চোখে নিজেদেরই মুক্তিযুদ্ধকে দেখতে পাই না।

 

ভাই ও বোনেরা,

এই ময়লা শুধু ভুলিয়ে দেয়নি, এই ময়লা আমাদের ঠেলে দিয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলতার অন্ধ গহ্বরে। আমরা আজ ধর্মান্ধতায় আচ্ছন্ন। আমরা ভুলে যাচ্ছি হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য, মানবিক সংস্কৃতি, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা। তার পরিবর্তে আমরা দৌড়াচ্ছি মধ্যযুগের মরুর বর্বরতার দিকে।

 

আপনারা দেখছেন, এই ময়লার ভাগাড়েই জন্ম নিচ্ছে এক বিভ্রান্ত প্রজন্ম। যে প্রজন্ম গর্ব করে বলে, আমরা রাজাকারের উত্তরসূরি। যে প্রজন্ম রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের উত্তরাধিকার বহন করছে বুক ফুলিয়ে। এই ময়লার দুর্গন্ধেই আজ পৃথিবী আমাদের চেনে—এক নারী-নিপীড়নকারী, ধর্মান্ধ জাতি হিসেবে।

 

আমাদের ঘরে ঘরে এখন মবের জন্ম। তারা সংখ্যালঘুদের বাড়ি ভাঙে, মন্দির পুড়ায়, পীর-আওলিয়ার মাজারে হামলা চালায়। আর আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি।
আমাদের এই নীরবতা, এই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা- এটাও এক ধরনের ময়লা!

 

ভাই ও বোনেরা,

এই ময়লা অস্বীকার করছে আমাদের জাতির পিতাকে।
এই ময়লা মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করছে। এই ময়লা আজ ইতিহাস বিকৃত করছে, শহিদ মিনারের বুক ভেঙে ফেলছে, স্বাধীনতার প্রতীককে অস্বীকার করছে। আরো ভয়ংকর হলো, এই ময়লার ভাগাড়েই জন্ম নিচ্ছে এক লাশের বাংলাদেশ।
 

যেখানে প্রতিদিন রক্ত ঝরে, যেখানে প্রতিদিন গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়, যেখানে প্রতিদিন নারীরা অসম্মানিত হয়, যেখানে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি পুড়ে যায়।

এটাই কি সেই বাংলাদেশ, যার জন্য আমাদের বাবা-মা রক্ত দিয়েছেন? এটাই কি সেই বাংলাদেশ, যেখানে শহিদরা স্বপ্ন দেখেছিলেন সমতার, ন্যায়ের আর মানবিকতার? না ভাই ও বোনেরা, এটা সেই বাংলাদেশ নয়। এটা হলো ময়লার বাংলাদেশ, যেখানে বিবেক অন্ধ, মনুষ্যত্ব পচে গেছে।

 

বন্ধুগণ,

ইসহাক দার একজন পাকি হয়ে হয়তো বিদ্রূপ করেছে। কিন্তু বিদ্রূপের ভেতরেও লুকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ সত্য।
সত্য হলো—আমাদের হৃদয় পরিষ্কার করতে হবে।
সত্য হলো—আমাদের মগজের জঞ্জাল ঝেড়ে ফেলতে হবে।
সত্য হলো—আমাদের মননের দুর্গন্ধ ধুয়ে ফেলতে হবে।

প্রশ্ন হলো—কীভাবে পরিষ্কার হবে এই ময়লা?

 

এটি হবে না বিদেশি পরামর্শে। এটি হবে না কূটনীতির বুলি শুনে। এটি হবে—আমাদের নিজেদের ভেতর থেকে।

 

প্রথমত, আমাদের ফিরতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে।
যেখানে শহিদদের রক্তে লেখা আছে স্বাধীনতার ঘোষণা।
যেখানে মা-বোনদের আত্মত্যাগে লুকানো আছে জাতির সম্মান। যেখানে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে মুক্তির অমোঘ ডাক।

 

দ্বিতীয়ত, আমাদের জাগাতে হবে মানবিক চেতনা।
ধর্মান্ধতা, উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা—এসব হলো ময়লার পাহাড়। এসব ভাঙতে হবে মুক্তচিন্তার আলো দিয়ে, শিক্ষার আলো দিয়ে, সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ‍্য দিয়ে।

 

তৃতীয়ত, আমাদের দাঁড়াতে হবে সত্যের পাশে। যারা জাতির পিতাকে অপমান করে, মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে, ইতিহাস বিকৃত করে—তাদের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। নীরবতা ভাঙতে হবে। কারণ নীরবতাই ময়লার সবচেয়ে বড় আশ্রয়।

 

ভাই ও বোনেরা,

আজ আমরা যদি এই ময়লা না সরাই, তবে আগামী প্রজন্ম জন্ম নেবে অন্ধকারে। তারা জানবেই না কেন এই দেশ স্বাধীন হলো। তারা জানবেই না কারা রক্ত দিলো, কারা আত্মত্যাগ করলো। তারা জানবেই না শহিদ মিনার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, কিংবা মুক্তিযোদ্ধার কবরের আসল মানে কী।

 

তখন বাংলাদেশ থাকবে, কিন্তু সেটা হবে এক লাশের বাংলাদেশ, যেখানে কেবল ধ্বংস, বিভ্রান্তি আর পরাজয়ের স্তুপ পড়ে থাকবে। কিন্তু আমি হাল ছাড়তে চাই না।
আমি বিশ্বাস করি, যত ময়লাই জমুক, একদিন না একদিন মানুষ জেগে উঠবে। মানুষ তার বিবেককে ধুয়ে-মুছে নতুন করে সাজাবে। মানুষ আবার ইতিহাসে ফিরে যাবে, মুক্তিযুদ্ধের শপথ স্মরণ করবে।

 

তাই আজ আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলছি, চলুন আমরা সবাই মিলে সেই ময়লা পরিষ্কার করি।চলুন আমরা আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরি। চলুন আমরা সত্যকে সত্য বলি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলি। কারণ আমাদের হৃদয় পরিষ্কার না হলে, আমাদের মননের আবর্জনা না সরলে, আমাদের বাংলাদেশ বাঁচবে না।

 

আমরা যদি চুপচাপ থাকি, যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকি, তবে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।ত্রিশ লক্ষ শহিদ, দুই লক্ষ মা-বোন আমাদের ক্ষমা করবে না। বঙ্গবন্ধুর আত্মা আমাদের ক্ষমা করবে না।

 

তাই বলছি, ভাই ও বোনেরা- 
এখনই সময়, ময়লা ঝেড়ে ফেলার।
এখনই সময়, অন্ধকার ভেদ করে আলোয় আসার।
এখনই সময়, ধ্বংস থেকে সৃষ্টি করার।


লেখকঃ চলচ্চিত্র নির্মাতা, সংগঠক ও গণমাধ্যমকর্মী

সব খবর