সম্প্রতি প্রথম আলো প্রকাশ করেছে এক মর্মন্তুদ সংবাদ-“জাহানারা ইমামের দেওয়া বই বিক্রি করেছে বাংলা একাডেমি, এখন দাম হাঁকা হচ্ছে লাখ টাকা।”
সংবাদটি কেবল একটি প্রশাসনিক অনিয়মের ইঙ্গিত নয়; এটি আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার গভীর পতনের প্রতীক। যেখানে ৮ টাকা কেজি দরে ইতিহাস বিক্রি হয়ে যায়!
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহের অমূল্য বইসমূহ বাংলা একাডেমিকে দান করেছিলেন। সেই বইগুলো ছিল তাঁর জীবনের সাক্ষ্য, তাঁর চিন্তা, তাঁর সংগ্রামের ইতিহাস। আজ সেই বইগুলো একাডেমির সংগ্রহশালা থেকে বেরিয়ে অনলাইনে বিক্রির তালিকায় উঠেছে। কেউ কেউ আবার সেই বইয়ের দাম হাঁকছেন লাখ টাকায়। ইতিহাস যেন নিলামে উঠেছে, বিবেক যেন বিক্রির পণ্যে পরিণত হয়েছে।
ঋত্বিক ঘটক একবার বলেছিলেন-“সভ্যতার মৃত্যু নেই, সভ্যতা পরিবর্তিত হয় কিন্তু চিরদিনের; মানুষ কখনও মরে না, কেবল ব্যক্তি মানুষ মরণশীল।”
ঋত্বিকের এই কথা আজ আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ফিরে আসে। সভ্যতা টিকে থাকে তখনই, যখন আমরা আমাদের অতীত ও স্মৃতিকে মর্যাদা দিই। কিন্তু সেই সভ্যতাই বিপন্ন হয়, যখন আমরা সেই স্মৃতিকে অবহেলায় বা বাণিজ্যে পরিণত করি।
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল রক্তে, ত্যাগে, নৈতিকতায়। সেই জন্ম ছিল এক নতুন সভ্যতার সূচনা। যেখানে ন্যায়, সত্য, মানবিকতা ও আত্মমর্যাদার ছিল উচ্চারণ। আর জাহানারা ইমাম ছিলেন সেই সভ্যতার নৈতিক মেরুদণ্ড। তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ শুধু একটি ডায়েরি নয়; এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্তর্লিখিত দলিল, আমাদের জাতিসত্তার আত্মকথা। তিনি নিজের বইগুলো বাংলা একাডেমিকে দিয়েছিলেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য, ব্যবসার পণ্য বানানোর জন্য নয়।
অথচ নয়া বন্দোবস্তের নামে আজ তাঁর স্মৃতিকে আমরা বাণিজ্যের বাজারে ফেলে দিচ্ছি-এ যেন নিজের জন্মভূমির স্মৃতি বিক্রি করা। আমরা ইতিহাস সংরক্ষণে নয়, ইতিহাস বিক্রিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
যে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের চেতনায়, যার কাজ ছিল বাঙালির সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ রক্ষা করা-সেই প্রতিষ্ঠান থেকেই যদি স্মৃতি বিক্রি হয়, তবে সেটি কেবল এক ভুল নয়; এটি এক সভ্যতার আত্মঘাত।
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে কেবল একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেনি; সৃষ্টি করেছিল এক নৈতিক ও মানবিক সভ্যতা-যেখানে সত্য, ন্যায় ও আত্মমর্যাদাই ছিল মূলভিত্তি। জাহানারা ইমাম সেই সভ্যতার মুখপাত্র ছিলেন। আজ তাঁর স্মৃতি বাণিজ্যের বাজারে ফেলে দিয়ে আমরা যেন নিজের জন্মভূমির ইতিহাসকেই বিক্রির টেবিলে তুলেছি।
ঋত্বিক ঘটকের কথায় ফিরে যাওয়া দরকার-সভ্যতা মরে না,কিন্তু সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় স্মৃতি, নৈতিকতা ও দায়িত্বের মধ্যে দিয়ে। যদি সেই দায়িত্ব হারিয়ে যায়, তবে সভ্যতা থাকবে কেবল নামমাত্র-ভেতরে থাকবে এক গভীর শূন্যতা।
কিন্তু হয়তো এখন ‘শূন্যতা’রও বাজার দর উঠেছে। বাংলা একাডেমিতে সম্প্রতি নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েকজন কর্মকর্তা সেই শূন্যতাকেই দক্ষতার সঙ্গে পূরণ করছেন-অবশ্যই সাহিত্য দিয়ে নয় বরং পদের মোহ ও চেয়ারের উষ্ণতায়। তাঁরা হয়তো ভাবছেন, জাহানারা ইমামের বই বিক্রি করে যে অর্থ উঠবে, তা দিয়ে নতুন পর্দা বা নতুন চেয়ার কেনা যাবে।
এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে-অট্টালিকা যত উঁচু হোক, যদি সাংস্কৃতিক বিবেক ভেঙে পড়ে, তবে জাতির মেরুদণ্ডই হারিয়ে যায়।
সভ্যতার মৃত্যু নেই-ঋত্বিক ঘটকের এই কথাটি তখনই সত্য হবে, যখন আমরা নিজের ইতিহাসের প্রতি সৎ থাকব, যখন জাহানারা ইমামের মতো মানুষদের স্মৃতি আমাদের সমাজের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে আসবে।