বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জলদস্যুদের তৎপরতা। ২০১৮ সালে সরকার ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করলেও, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর থেকে পুরোনো ও পলাতক অপরাধীদের নেতৃত্বে নতুন করে সক্রিয় হয়েছে একাধিক দস্যু চক্র।
সরকারি তথ্যমতে, বর্তমানে সুন্দরবনে অন্তত ৯টি জলদস্যু দল সক্রিয় রয়েছে, যদিও বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ পর্যন্ত হতে পারে। এসব চক্র ‘নিরাপত্তা চাঁদা’র নামে জেলেদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছে। যারা টাকা দেয়, তারা মাছ ধরার অনুমতি পায়; আর যারা দেয় না, তাদের অপহরণ করে ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ দাবি করা হয়।
গত ১ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে প্রবেশ উন্মুক্ত হওয়ার পর মাত্র দুই মাসেই অপহরণ ও মুক্তিপণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। অধিকাংশ ভুক্তভোগী ভয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ না করায় প্রকৃত সংখ্যা জানা কঠিন।
২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৩২টি জলদস্যু দলের ৩২৮ সদস্য আত্মসমর্পণ করেছিল। তারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি জমা দেয়। এরপরই সরকার সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করে। তবে বর্তমানে করিম শরীফ, জাহাঙ্গীর, দয়াল, দুলাভাই, ছোট সুমন, হান্নান, রাঙ্গা ও ছোটন বাহিনীসহ একাধিক চক্র আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
কোস্টগার্ডের দাবি, তারা ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ৪৫ জন জলদস্যু ও সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং ৪৮ জন জেলেকে উদ্ধার করেছে। তারা বলছে, পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে, তবে কিছু ছোট দল পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে।
বনজীবীরা বলছেন, দস্যুরা নিয়মিত আস্তানা বদলায় এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি বন্দুক, শটগান, দা-চাপাতি ব্যবহার করে। অনেক জেলে ভয়ে অভিযোগ করতে চান না, কারণ তাদের আবার বনেই ফিরতে হয়।
বাগেরহাটের বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, বর্তমানে শরীফ, জাহাঙ্গীর ও আসাদ গ্রুপ সক্রিয়। তিনি বলেন, “কিছু অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, তবে সঠিক সংখ্যা জানা নেই।”
সাংবাদিক মোহসিন উল হাকিম বলেন, “জেলেদের কাছ থেকে আগাম চাঁদা নেওয়া হয়। যারা দেয়, তারা নিরাপদে মাছ ধরতে পারে। যারা দেয় না, তারা অপহরণের শিকার হয়।”
তবে কোস্টগার্ডের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক বনজীবী। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, কোস্টগার্ডের অভিযান অনেক সময় ‘দেখানোর জন্য’ হয় এবং মুক্তিপণ নেওয়ার পর উদ্ধার দেখানো হয়।
খুলনার জেলা প্রশাসক তৌফিকুর রহমান জানান, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও নদী পুলিশ যৌথভাবে কাজ করছে এবং অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
প্রশাসনের দাবি, সুন্দরবনকে পুনরায় দস্যুমুক্ত করতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে বাস্তবতা বলছে, বনজীবীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে এই ভয় ও অনিশ্চয়তা কাটবে না।