সর্বশেষ

সরকার বদলায়, বিশৃঙ্খলা নয়

পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ এখনো অদৃশ্য শক্তির হাতে

প্রকাশিত: ২১ অক্টোবর ২০২৫, ০১:২২
পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ এখনো অদৃশ্য শক্তির হাতে

প্রতিদিন সকালে ঢাকার রাস্তায় অফিসগামী মানুষের একটাই কামনা ‘আজ যেন সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি।’ যানজট, হর্ন, ধোঁয়া আর বেপরোয়া চালকদের দৌড়ে রাজধানীর সড়ক যেন প্রতিদিনের এক যুদ্ধক্ষেত্র। বাস থামবে কি না, উঠতে পারা যাবে কি না সবকিছুই যেন ভাগ্যের হাতে। আর সেই ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ এখন এমন এক সিস্টেমের হাতে, যার নাম বাংলাদেশের পরিবহন খাত।

 

গোলাপি বাসের স্বপ্ন, ধুলোর বাস্তবতা

 

সরকার বদলের ছয় মাস পর, গত ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ঘোষণা দিয়েছিল আব্দুল্লাহপুর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করা ২১টি কোম্পানির বাস একক কোম্পানির অধীনে আনা হবে। সব বাস হবে গোলাপি রঙের, টিকিট কাউন্টারভিত্তিক ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, অবশেষে শৃঙ্খলা ফিরবে রাজধানীর রাস্তায়।

 

কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই সেই গোলাপি রঙ মিশে গেল ধুলোয়। প্রকল্পের শুরুতে আশার আলো জ্বলেও শেষ হয় অজুহাতের অন্ধকারে। দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব আর স্বার্থের সংঘাত আবারও উন্নয়নের রংকে ম্লান করে দিয়েছে।

 

নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?

 

দেখতে মনে হয় সরকারের হাতে স্টিয়ারিং, কিন্তু বাস্তবে পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অদৃশ্য এক ক্ষমতাজোটের মাধ্যমে যেখানে মালিক-শ্রমিক সমিতি, রাজনৈতিক গোষ্ঠী আর চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট মিলে তৈরি করেছে এক অপ্রকাশ্য রাজত্ব। এই রাজত্বে নিয়ম মানা মানে ক্ষতি, আর বিশৃঙ্খলা মানে লাভ।

 

যাত্রীদের দুর্ভোগ, চালকদের অবৈধ প্রতিযোগিতা আর ট্রাফিক ব্যবস্থার ভাঙন সবই এই রাজনীতিকৃত সিস্টেমের ফল।

 

চুক্তির জালে জিম্মি চালকরা

 

পরিবহন খাতে চালক ও মালিকের সম্পর্ক ব্যবসায়িক নয়, বরং এক প্রকার বাজির মতো। চালককে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিতে হয়, যেভাবেই হোক। ফলে তার আয় নির্ভর করে বেশি ট্রিপ ও বেশি যাত্রী তুলতে পারার ওপর।

 

এই ‘চুক্তি সংস্কৃতি’ পুরো খাতটিকে প্রতিযোগিতার নামে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। চালকরা হর্ন বাজিয়ে, স্টপেজ এড়িয়ে, ট্রাফিক নিয়ম ভেঙে চলাচল করছেন শুধুমাত্র নিজের আয়ের জন্য। যাত্রীর কাছে এটি এখন বাঁচা-মরার প্রতিযোগিতা।

 

কাগজে ফিটনেস, রাস্তায় বিপর্যয়

 

পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে চলাচলরত অধিকাংশ বাসেরই ফিটনেস সার্টিফিকেট রয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভয়াবহ। ভাঙাচোরা বাস, দুর্বল ব্রেক, ধোঁয়া নির্গমন আর অচল ইঞ্জিন সবই চলছে প্রশাসনের চোখের সামনে। ‘কাগজে ফিট’ বাসগুলো বাস্তবে যাত্রীদের জন্য চলন্ত বিপদে পরিণত হয়েছে।

 

রাজনীতি ও রুট দখল

 

পরিবহন খাত শুধু অবকাঠামো নয়, এটি এখন রাজনীতিরও একটি ক্ষেত্র। কোন মালিক কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক, কোন রুট কার দখলে এই হিসাবেই নির্ধারিত হয় পরিবহন নীতি। একদল ক্ষমতাবান ব্যক্তি এই খাতকে ব্যবহার করছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে।

 

ফলে নতুন নীতি বা প্রকল্প আসলেই সৃষ্টি হয় প্রতিরোধ ও বিশৃঙ্খলা। মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা নীতিনির্ধারণকে পরিণত করে ক্ষমতার খেলা হিসেবে।

 

তিন স্তরের ব্যর্থতা

 

পরিবহন সংকটের পেছনে দায়ী তিনটি স্তর নীতি, তদারকি ও বাস্তবায়ন। নীতিনির্ধারকেরা বাস্তবতা বিবেচনা না করেই সিদ্ধান্ত নেন; তদারকি সংস্থাগুলো কাগজপত্রে ব্যস্ত; আর মাঠপর্যায়ে রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়া। ফলে ফিটনেসবিহীন যানবাহন, লাইসেন্সবিহীন চালক ও রুট দখলের প্রতিযোগিতা বেড়েই চলছে।

 

পরিবর্তন কোথায়?

 

অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর দেখা যাচ্ছে, শুধু সরকার বদলেছে, সিস্টেম নয়। একই বিশৃঙ্খলা, একই সিন্ডিকেট শুধু স্লোগান পাল্টেছে। যাত্রীদের দুর্ভোগ রয়ে গেছে অপরিবর্তিত।

 

নতুন রং নয়, নতুন চিন্তা দরকার

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবহন খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পেশাদার ব্যবস্থাপনা ও ন্যায্য আয়ের কাঠামো। শুধু বাসের রং বদলিয়ে নয়, বদলাতে হবে সিস্টেম যেখানে চালক, মালিক ও যাত্রী সবাই থাকবে নিরাপদ ও জবাবদিহির আওতায়।

 

ঢাকার রাস্তায় প্রতিটি বাস এখন একেকটি গল্প; ক্লান্ত চালক, রুষ্ট যাত্রী আর নিস্তেজ প্রশাসন। এই গল্প বদলাতে হলে রং নয়, বদলাতে হবে মানসিকতা। গোলাপি বাসের অভিজ্ঞতা আমাদের একটাই শিক্ষা দেয় পরিবর্তন কাগজে নয়, সিস্টেমে ঘটাতে হবে।

সব খবর

আরও পড়ুন

শেরপুরে জারি গানের আসর ঘিরে সংঘর্ষ, অবরুদ্ধ গ্রামে আতঙ্ক

তৌহিদী জনতা ও স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা অব্যাহত শেরপুরে জারি গানের আসর ঘিরে সংঘর্ষ, অবরুদ্ধ গ্রামে আতঙ্ক

রাজশাহীতে যাচাই ছাড়াই ঋণ দিচ্ছে আড়াই হাজার সমিতি এবং এনজিও

বাড়ছে আত্মহত্যা ও সহিংসতা রাজশাহীতে যাচাই ছাড়াই ঋণ দিচ্ছে আড়াই হাজার সমিতি এবং এনজিও

অবৈধ বালু উত্তোলনে আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার ঝুঁকিতে

ময়মনসিংহে বিজিবির সংবাদ সম্মেলন অবৈধ বালু উত্তোলনে আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার ঝুঁকিতে

আলোর উৎসবে ব্যস্ত রংপুরের কুমারপাড়া

দীপাবলি ও কালীপূজো একসঙ্গে আলোর উৎসবে ব্যস্ত রংপুরের কুমারপাড়া

আইপিডির প্রতিবেদন বলছে, ছিল কাঠামোগত ও অবহেলাজনিত ত্রুটি

রূপনগরে আগুন আইপিডির প্রতিবেদন বলছে, ছিল কাঠামোগত ও অবহেলাজনিত ত্রুটি

নির্মাণ, যানবাহন ও ফুটপাথজুড়ে সিন্ডিকেটের দাপট

কুমিল্লায় বিএনপির অভিনব চাঁদাবাজি নির্মাণ, যানবাহন ও ফুটপাথজুড়ে সিন্ডিকেটের দাপট

চট্টগ্রামসহ ৪ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ

পূর্বের আদেশ বাতিল চট্টগ্রামসহ ৪ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ

মিরপুরের ভয়াবহ আগুনে ১৬ জনের মৃত্যু

এখনো নিখোঁজ ১৩ জন মিরপুরের ভয়াবহ আগুনে ১৬ জনের মৃত্যু