চট্টগ্রাম নগরের খালগুলো এখন প্লাস্টিক বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। নগরের বৃহত্তর এলাকার পানি চাক্তাই খাল হয়ে কর্ণফুলী নদীতে পড়ে। কিন্তু চাক্তাই খালের বাকলিয়া সৈয়দ শাহ রোড অংশে প্রায় অর্ধ কিলোমিটারজুড়ে দেখা যায় প্লাস্টিক মোড়কজাত পণ্যের স্তূপ। চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ-বাকলিয়া থেকে চকবাজার-বহদ্দারহাট পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকায় ৮০ শতাংশ অংশই প্লাস্টিক বর্জ্যে ভরপুর। একই চিত্র নগরের ৫৭টি খালে।
খালগুলোতে ভেসে উঠছে প্লাস্টিকের প্যাকেট, ফলে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। নগরের পানি চলাচলের সুবিধায় খাল-নালা-নর্দমা খনন করা হলেও অধিকাংশই এখন বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নালা-নর্দমাকে ময়লার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করছে। পয়োবর্জ্য, কলকারখানা ও মেডিকেল বর্জ্যের বড় অংশও নালায় ফেলা হচ্ছে। উন্মুক্ত নালাগুলোতে সাধারণ মানুষও বর্জ্য ফেলছে। এসব বর্জ্য খাল হয়ে কর্ণফুলীতে গিয়ে নদীর পানি দূষিত করছে। নদীর তলদেশে জমছে পলিথিন-প্লাস্টিকের স্তর, যা ড্রেজিংয়ে স্পষ্টভাবে পাওয়া যাচ্ছে। এতে নদীর জীববৈচিত্র্য ও মৎস্য সম্পদ হুমকির মুখে পড়ছে।
চট্টগ্রামে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের বসবাস। নগরে দৈনিক সাড়ে ৩ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হলেও চসিক সংগ্রহ করে প্রায় ২২ হাজার টন। বাকি ১৩ হাজার টন বর্জ্য প্রতিদিন খাল-নালা-নর্দমা হয়ে কর্ণফুলীতে গিয়ে পড়ছে। বর্তমানে আরেফিননগর ও হালিশহরে দুটি বড় বর্জ্যাগার রয়েছে, দুটিই এখন পূর্ণ। এছাড়া রয়েছে ছয়টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস)।
চসিকের উপপ্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা প্রণব কুমার শর্মা বলেন, খাল-নালা-নর্দমায় বর্জ্য ফেলা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। নগরবাসীকে সচেতন করতে মাইকিংসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে টিম গঠন করে তদারকি করা হচ্ছে, কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, প্লাস্টিক বর্জ্য নদীর মৎস্য সম্পদে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলছে। মাছের প্রজননক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে, পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক ও রাসায়নিক দূষণ বাড়ছে। ফলে নদীতে মাছের সংখ্যা কমছে। তিনি জানান, মিশ্র পানির ২৫ প্রজাতি, মিঠাপানির ৩০ প্রজাতি ও পরিযায়ী প্রজাতির মাছ এখন প্রায় বিলুপ্ত। বর্তমানে ফাইস্যা, পোয়া ও কাচকি ছাড়া অন্য মাছ তেমন পাওয়া যায় না।
পরিকল্পিত ফোরাম চট্টগ্রামের যুগ্ম সম্পাদক তাসলিমা মুন বলেন, প্লাস্টিকের রাসায়নিক উপাদান পানিতে মিশে মাটি ও পানি দূষণ করছে। এতে নগরের জলাবদ্ধতা, মানব স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের ওপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। খাল-নর্দমা থেকে প্লাস্টিকের ছোট টুকরা কৃষিজমিতে গিয়ে মাটির উর্বরতা কমাচ্ছে, পানি ধারণক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং উৎপাদনশীলতায় ঘাটতি তৈরি করছে। নালা বন্ধ হয়ে গেলে পয়োবর্জ্য উপচে রাস্তায় উঠে আসে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি।
চট্টগ্রামের খাল-নালা ও কর্ণফুলী নদী প্লাস্টিক বর্জ্যে বিপর্যস্ত। প্রতিদিন ১৩ হাজার টন বর্জ্য নদীতে গিয়ে পড়ছে, যা শুধু জলাবদ্ধতা নয়, জীববৈচিত্র্য, কৃষি ও মানব স্বাস্থ্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরবাসীর সচেতনতা, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়।