খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে টানা পাঁচ দিনের উত্তেজনার মধ্যে রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সংঘর্ষ, গুলি ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। নিহতরা আদিবাসী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সদস্য বলে নিশ্চিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এ ঘটনায় মেজরসহ ১৩ সেনাসদস্য, গুইমারা থানার ওসিসহ তিনজন পুলিশ সদস্য ও আরও অনেকে আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে অন্তত চারজনকে খাগড়াছড়ি জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতে অষ্টম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়েরের পর থেকেই খাগড়াছড়িতে উত্তেজনা বিরাজ করে। জুম্ম ছাত্র-জনতা ব্যানারে বুধবার থেকে টানা অবরোধ কর্মসূচি চলতে থাকে। শুক্রবার নারী নিপীড়নবিরোধী সমাবেশের পর শনিবার সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ চলাকালে খাগড়াছড়ি সদরে কয়েক দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ভাঙচুর হয়। পরে প্রশাসন সদর, পৌর এলাকা ও গুইমারায় ১৪৪ ধারা জারি করে।
রোববার সকাল থেকে ফের অবরোধ চলাকালে দুপুরে গুইমারার রামেসু বাজারে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর ১২টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের বাকবিতণ্ডা শুরু হলে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। একপর্যায়ে গুলি ছোঁড়া হয়। আদিবাসী অন্তত চার তরুণ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আরও কয়েকজন গুরুতর আহত হন।
সংঘর্ষের সময় ২০–২৫ জন মুখোশধারী লোক রামেসু বাজারে লুটপাট চালিয়ে দোকানপাট ও বসতবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। স্থানীয়দের দাবি, অন্তত ২০টি দোকান, কয়েকটি বাড়িঘর ও মোটরসাইকেল পুড়ে যায়। বাজারের দোকানমালিকদের অধিকাংশই আদিবাসী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বলে জানা গেছে। ঘটনাস্থলের ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের সভাপতি উয়াফ্রে মারমা অভিযোগ করেন, "আমাদের দোকানপাট ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেককে গুলি করা হয়েছে। এখনও অনেক গুলিবিদ্ধ আহত অবস্থায় পড়ে আছে।" অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক মো. আব্দুল মজিদ আদিবাসি গোষ্ঠীগুলোকে সহিংসতার জন্য দায়ী করেন।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব পলাশ জানান, গুলিতে চারজন নিহত হয়েছেন এবং আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন। মরদেহগুলো খাগড়াছড়ি জেলা হাসপাতালে রাখা হয়েছে। সোমবার ময়নাতদন্ত শেষে মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট হবে।
খাগড়াছড়ি জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ সাবের জানিয়েছেন, নিহত চারজন পুরুষের মরদেহ মর্গে রাখা হয়েছে। আহত চারজন চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে দুজনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, "গুইমারা উপজেলায় দুষ্কৃতকারীদের হামলায় তিনজন পাহাড়ি নিহত এবং সেনা ও পুলিশের সদস্যসহ বহু মানুষ আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেওয়া হবে না।" মন্ত্রণালয় সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
খাগড়াছড়িতে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে রোববার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মতবিনিময় সভা করেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। তিনি অভিযোগ করেন, "তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনে পাহাড়ে নতুন ইস্যু তৈরি করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করা।" তিনি পাহাড়ে অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন।
অন্যদিকে জুম্ম ছাত্র-জনতা ফেসবুক পেজে বিবৃতিতে জানায়, তাদের আট দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধ কর্মসূচি চলবে।
সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের পর থেকে খাগড়াছড়ি জেলা শহর ও গুইমারায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। শহরের সব দোকানপাট বন্ধ, সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। পথে পথে ব্যারিকেড থাকায় খাগড়াছড়িমুখী যাত্রীরা চট্টগ্রামে আটকা পড়েছেন।
খাগড়াছড়ির বাস কাউন্টারগুলোতে বাস ছাড়তে না পারায় যাত্রীরা ভোগান্তিতে পড়েছেন। স্থানীয়রা বলছেন, এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন স্থানে টহল জোরদার করেছে এবং প্রশাসনের দাবি—পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এক কিশোরীর ধর্ষণকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া আন্দোলন শেষ পর্যন্ত গুলিতে চারজনের প্রাণহানি, সেনা ও পুলিশের সদস্যসহ বহু মানুষের আহত হওয়া এবং বাজার-ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ভয়াবহ সহিংসতায় গড়িয়েছে। প্রশাসন ও সরকার শান্ত থাকার আহ্বান জানালেও খাগড়াছড়ির পরিস্থিতি এখনও উত্তেজনাপূর্ণ ও অনিশ্চিত।