চট্টগ্রামে বৃষ্টি মানেই আতঙ্ক। আকাশে মেঘ জমলেই নগরবাসীর মনে জাগে শঙ্কা—আজ আবার ডুববে না তো? সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি জমে যায় নগরীর প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে। অচল হয়ে পড়ে যানবাহন, বিপর্যস্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষার্থী ও অফিসগামী মানুষের দুর্ভোগ যেন নিত্যদিনের চিত্র। গত পাঁচ বছরে জলাবদ্ধতায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন, আর এ বছরই পানিতে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের।
অথচ এই জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রামে চলছে চারটি মেগা প্রকল্প, যার মোট ব্যয় ১৪ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ২০১৭ সালে ৩৬টি খাল নিয়ে শুরু করে একটি বৃহৎ প্রকল্প, যার ব্যয় ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকায়। প্রকল্পের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হলেও হিজড়া খালের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জমি অধিগ্রহণ ও সংস্কারকাজে ধীরগতি থাকায় নগরবাসী পুরোপুরি স্বস্তি পাচ্ছে না।
এই প্রকল্পে রয়েছে ১৭৬ কিমি প্রতিরক্ষা দেয়াল, ৪৫টি সেতু, ছয়টি কালভার্ট, ৪২টি সিল্ট ট্র্যাপ, পাঁচটি রেগুলেটর, ১০.৭৭ কিমি নতুন নালা, ৮৫.৬৮ কিমি খালের পাশে সড়ক এবং ১৫.৫০ কিমি নালা সম্প্রসারণ। সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কন্সট্রাকশন ব্রিগেড এই কাজ বাস্তবায়ন করছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে ২৩টি স্লুইসগেট নির্মাণের কাজ চলছে। কর্ণফুলী নদীর তীরে বাঁধসহ রাস্তা নির্মাণে ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকার প্রকল্পে ইতিমধ্যে ১২টি স্লুইসগেট তৈরি হয়েছে। বাড়ইপাড়া খাল খননে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা, যার ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জলাবদ্ধতা নিরসনে চার উপদেষ্টাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন। তারা সরেজমিনে চট্টগ্রাম পরিদর্শন করে চার মাসের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছেন। এতে রয়েছে—পাহাড় কাটা বন্ধ, বিদ্যুৎ ও ওয়াসা সংযোগ বিচ্ছিন্ন, পলিথিন ও বোতল রিসাইক্লিং, স্লুইসগেট ও পাম্পের ক্ষমতা বৃদ্ধি, কালভার্টের উচ্চতা বাড়ানো, ইউটিলিটি লাইন সরানো এবং ব্যর্থ সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
তবে বাস্তবতা বলছে, আইন থাকা সত্ত্বেও জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান সংরক্ষণে ব্যর্থতা প্রকট। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামে জলাশয়ের সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ২৫০, যা ২০০৬-০৭ সালে কমে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫২৩-এ। জলাশয় ভরাট, পাহাড় কাটা এবং খাল দখল জলাবদ্ধতার মূল কারণ।
গত এক দশকে জলাবদ্ধতায় খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, আসাদগঞ্জ ও কোরবানীগঞ্জে ২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ২০২৩ সালে চসিকের ১ হাজার ৩০০ কিমি সড়কের মধ্যে ৫০ কিমি সড়ক, দুই কিমি ফুটপাত ও দুই কিমি ড্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, “জলাবদ্ধতা সমস্যা ৫০-৬০ শতাংশ সমাধান হয়েছে। তবে পুরোনো যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করা কঠিন। আমরা ৪০০ কোটি টাকা চেয়েছি, পেয়েছি ৩০০ কোটি। ‘ময়লা থেকে সম্পদ’ প্রকল্পে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চাইলেও মন্ত্রণালয় সাড়া দিচ্ছে না।”
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. ইকবাল সরওয়ার বলেন, “জলাবদ্ধতা নিরসনে আধুনিক ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান, খাল-নালা উদ্ধার, নিয়মিত ড্রেজিং, সমন্বিত সংস্থা, পরিকল্পিত কালভার্ট নির্মাণ, পাহাড় কাটা বন্ধ এবং রাজনৈতিক ঐক্য প্রয়োজন।”
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, “চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতার মূল কারণ পাহাড় কাটা ও খাল ভরাট। ঢালু জমি সমতল হওয়ায় পানি আটকে থাকে, আর খালের গভীরতা কমে যাওয়ায় পানি নামতে পারে না।”
১৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও চট্টগ্রামবাসীর প্রশ্ন—কবে মিলবে প্রকৃত সুফল? জলাবদ্ধতা কি শুধুই প্রকল্পের কাগজে থাকবে, নাকি বাস্তবেই বদলাবে নগরীর চিত্র?