আদিবাসী কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনার জেরে খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় বিক্ষোভে হামলা থেকে সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের পর এলাকা এখনো থমথমে। সহিংসতায় তিন যুবক নিহত হওয়ায় পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। তিন পার্বত্য জেলায় চলছে জুম্ম ছাত্র–জনতার ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ, আর প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারাও বহাল রয়েছে।
গত রোববার গুইমারার রামেসু বাজারে ভয়াবহ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বাজারের অর্ধশতাধিক দোকান, বসতবাড়ি এবং একটি তিনতলা ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ভবনটিতে সরকারি ও বেসরকারি অন্তত ১৫টি প্রতিষ্ঠান ছিল—যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সমাজসেবা কার্যালয়, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড, সূর্যের হাসি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন অফিস। আগুনে কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সোমবার সকালেও রামেসু বাজারে পোড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা ছাইভস্ম থেকে ব্যবহারযোগ্য কিছু উদ্ধার করার চেষ্টা করছিলেন। অনেক পরিবার গৃহহারা হয়ে পড়েছে। পাহাড়ি নারী মিবু মারমা বলেন, “সব শেষ হয়ে গেছে। আমার ঘরবাড়ি না পুড়িয়ে আমাকেই আগুনে দিতো, তাহলে হয়তো এত কষ্ট সহ্য করতে হতো না।”
সহিংসতার ঘটনায় নিহত তিনজন হলেন—গুইমারার আথুই মারমা (২১), আথ্রাউ মারমা (২২) এবং তৈইচিং মারমা (২০)। সোমবার তাদের ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও গুইমারায় টানা তৃতীয় দিনের মতো ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সড়কগুলো প্রায় ফাঁকা, দোকানপাটও বন্ধ। স্থানীয়রা আতঙ্কে ঘরবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
অবরোধের কারণে খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামগামী যানবাহন সীমিত আকারে চলাচল শুরু করলেও রাঙামাটি ও জেলার ৯ উপজেলায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। জরুরি সেবা ছাড়া অন্য যান চলাচল বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে।
সোমবার দুপুরে প্রশাসন ও জুম্ম ছাত্র–জনতার নেতাদের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠকে তাদের আট দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়। জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম জানান, “অবরোধ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি জটিল থাকবে। তবে দাবি নিয়ে আলোচনা ইতিবাচকভাবে চলছে।”
জুম্ম ছাত্র–জনতা জানায়, তারা কোনো রাজনৈতিক বা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নয়। কিশোরী ধর্ষণের ঘটনায় ন্যায়বিচারের দাবিতেই তাদের আন্দোলন। দ্রুত এবং সন্তোষজনক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি।
এ ঘটনার মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ ধর্ষণের ঘটনাকে “ভুয়া ধর্ষণ” বলে মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েন। পরে তিনি ফেসবুক পোস্টে শব্দচয়নের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এর প্রতিবাদে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি অলিক মৃ এনসিপি থেকে পদত্যাগ করেছেন।
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অভিযোগ করেছেন, “ভারত বা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনে খাগড়াছড়িতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে।” তিনি বলেন, পাহাড় থেকে গুলি চালানোর জন্য অনেক সময় অস্ত্র বাইর থেকে আসে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে দোকান ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, “কারা এ কাজ করেছে সবাই জানে, কিন্তু ভয় আছে বলেই প্রকাশ করতে পারছি না।”
ধর্ষণ, সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনার পর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ দানা বাঁধছে। তাদের মতে, ঘটনাগুলো নিছক সংঘর্ষ নয়, বরং আদিবাসীদের লক্ষ্য করে পরিকল্পিত হামলা।
প্রশাসন শান্তি প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দিলেও জুম্ম ছাত্র–জনতার আট দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। তারা বলছে, “আমাদের আন্দোলন ন্যায়বিচারের জন্য। কোনো দমননীতি দিয়ে এটি বন্ধ করা যাবে না।”
খাগড়াছড়ি এখনো পোড়া ঘর–দোকানের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। তিনটি প্রাণহানি, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ক্ষত নিয়ে পাহাড়ি জনপদ শোকে স্তব্ধ।