সর্বশেষ

মাজার ভাংচুর

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ‘নুরাল পাগলা’র কবর ভেঙে মরদেহ উত্তোলন, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল তৌহিদী জনতা

প্রকাশিত: ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩:৫৪
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ‘নুরাল পাগলা’র কবর ভেঙে মরদেহ উত্তোলন, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিল তৌহিদী জনতা

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে ‘নুরাল পাগলা’র মরদেহ কবর থেকে তুলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে তৌহিদী জনতা নামের মব। এ সময় তার প্রতিষ্ঠিত দরবার শরিফ ও বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সংঘর্ষ ও হামলায় ভক্ত ও স্থানীয়দের পাশাপাশি পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে একজন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।

 

হামলার ঘটনাপ্রবাহ

 

শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) জুমার নামাজের পর পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জুড়ান মোল্লাপাড়ায় শত শত মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। ‘ঈমান-আকিদা রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মহিউদ্দিন আনসার ক্লাবে সমাবেশ করে। 

 

 

বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন গোয়ালন্দ উপজেলা ইমাম কমিটির সভাপতি মাওলান জালাল উদ্দিন, গোয়ালন্দ উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আইয়ুব আলী খান, পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম মণ্ডলসহ বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ।

 

পরে তৌহিদি জনতা নামধারি এই মব দরবারের দিকে যেতে চাইলে প্রশাসন তাদের নিবৃত করার চেষ্টা করে। এ সময় গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সরকারি গাড়ি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসির গাড়ি ভাঙচুর করেন তারা। এ সময় ইউএনও-পুলিশের গাড়ি ছাড়াও, স্থানীয় প্রশাসনের যানবাহন ভাঙচুর করা হয়। পুলিশের অন্তত পাঁচ সদস্য ও উপজেলা প্রশাসনের দুই কর্মকর্তা আহত হন।
 

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুরুতে দরবারের ভেতরে থাকা ভক্তরা প্রতিরোধের চেষ্টা করলে দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ হয়। পরে কয়েকশ সংঘবদ্ধ লোক দরবারে প্রবেশ করে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালায়।

 

 

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ উপস্থিত থাকলেও মবের চাপ সামলাতে ব্যর্থ হয়। পরে সেনাবাহিনী ও র‍্যাব ঘটনাস্থলে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ নেয়।

 

মরদেহ উত্তোলন ও দাহ

 

হামলাকারীরা প্রথম দফায় হামলার পর কিছুটা দূরে সরে গিয়ে আবারও সমবেত হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় তারা দরবার ও বাড়িতে হামলা চালিয়ে কবর থেকে নুরুল হকের মরদেহ উত্তোলন করে। পরে মরদেহটি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোয়ালন্দ বাসস্ট্যান্ডের পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে প্রকাশ্যে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে।

 

হামলাকারীদের একাংশের দাবি, নুরুল হক নিজেকে শুধু ইমাম মাহাদি নন, বরং খোদাও বলে প্রচার করেছেন। তার কালেমা ও আজান বিকৃত করা, কবর উঁচু করে কাবার আদলে নির্মাণ করা এবং শরিয়তবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড সে হামলাকারীদের ক্ষুব্ধ করেছে।

 

 

স্থানীয় আল আমিন নামে একজন বলেন, “নুরাল পাগল শরিয়তের বাইরে চলে গিয়েছিল। তাই আজ জনতা তার দরবার ভেঙেছে, বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে এবং লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দিয়েছে।”

 

কামরুল ইসলাম নামের আরেকজন বলেন, “লাশ না পোড়ালে আবারও ভণ্ডামি শুরু হতো। তাই এ সিদ্ধান্ত।”

 

আহত ও নিহত

 

গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, অন্তত ২২ জন আহতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গুরুতর অবস্থায় ১৯ জনকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেই দেবগ্রাম ইউনিয়নের বাসিন্দা রাসেল মোল্লা (২৮) মারা যান।

 

জেলা সিভিল সার্জন এস এম মাসুদ জানান, “আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন মারা গেছেন।”

 

প্রশাসনের ব্যাখ্যা

 

গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদুর রহমান বলেন, “আমরা বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছিলাম। পরিবারের সঙ্গে বৈঠক করে কবর নিচু ও রঙ পরিবর্তনসহ কিছু দাবি পূরণও হয়েছিল। কিন্তু শুক্রবারের বিক্ষোভে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়।”

 

 

রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার কামরুল ইসলাম বলেন, “জুমার নামাজের পর তৌহিদী জনতা সমবেত হয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়, গাড়ি ভাঙচুর করে এবং পরে দরবারে অগ্নিসংযোগ চালায়। সেনাবাহিনী ও র‍্যাবের সহযোগিতায় পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে।”

 

নুরুল হকের পটভূমি

 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে নুরুল হক নিজেকে ‘ইমাম মাহাদি’ দাবি করে এলাকায় আলোচিত হন। সে সময় চাপের মুখে এলাকা ছাড়লেও পরবর্তীতে ফিরে এসে গোয়ালন্দে দরবার শরিফ প্রতিষ্ঠা করেন।

 

গত ২৩ আগস্ট ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মারা যান। পরে তার ওসিয়ত মোতাবেক দরবার প্রাঙ্গণে মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচু বেদিতে দাফন করা হয়।বেদিটি হামলাকারীদের ভাষায় 'কাবা শরিফে'র আদলে রঙ করা হয় এবং ‘ইমাম মাহাদি দরবার শরিফ’ লেখা সাইনবোর্ডও টানানো হয়। এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে 'আলেম' বলে পরিচিত গোষ্ঠী ও তৌহিদী জনতার মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়।

 

 

উত্তেজনা ও প্রশাসনিক প্রচেষ্টা

 

প্রশাসনের উদ্যোগে কবর সমতল করা, রঙ পরিবর্তন ও সাইনবোর্ড অপসারণ করা হলেও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় চেয়ে পরিবার সমঝোতা করলেও শুক্রবার হামলাকারীরা হঠাৎ সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে।

 

এ ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। সেনাবাহিনী ও র‍্যাব এখনো সেখানে অবস্থান করছে। পরিস্থিতি থমথমে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

সব খবর