কুমিল্লার হোমনা উপজেলার আসাদপুর গ্রাম। এক সময়ের শান্তশিষ্ট এ গ্রাম এখন আতঙ্ক আর নীরবতায় ডুবে আছে। ১৮ই সেপ্টেম্বরের ঘটনায় বদলে গেছে পুরো গ্রামের চিত্র। স্থানীয় আলেক শাহ’র ছেলে ফেসবুকে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তিমূলক পোস্ট দিয়েছে এমন অভিযোগে তৌহিদী জনতা মাজার, বসতবাড়ি ও দোকানপাটে হামলা চালায়। ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয় চারটি মাজার ও বহু ঘরবাড়ি। ঘটনাটির পর ভয়ে গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—একজনের অপরাধে কেন শত বছরের ইতিহাস, গ্রামীণ সংস্কৃতি আর সাধু-সন্ন্যাসীদের আশ্রয়স্থল মাজারগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো? কেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে পথে বসতে হলো?
আসাদপুর বাজারের কফিল উদ্দিন শাহ মাজারে গিয়ে দেখা যায়, পোড়া টিন, ভাঙা কাঁচ আর ছাই হয়ে যাওয়া খাট-বিছানা। কাঠমিস্ত্রিরা মেরামতের চেষ্টা চালাচ্ছেন। মাজারটির পাশাপাশি আবদু শাহ, কালাই শাহ ও হাওয়ালি শাহ মাজারও হামলার শিকার হয়। শত শত মানুষের আধ্যাত্মিক ভরসাস্থল এ স্থানগুলো মুহূর্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ভুক্তভোগী আলেক শাহ বলেন, “আমার ছেলে অন্যায় করেছে, আমি আইন দিয়ে বিচার চাই। কিন্তু আমার ফার্মেসি, মাজার, বসতভিটা কেন পোড়ানো হলো? আমি তো নিঃস্ব হয়ে গেছি।” চোখের পানিতে তিনি জানান, প্রায় ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে, শুধু ওষুধপত্রেই ২০ লাখ টাকার বেশি।
তার স্ত্রী মানোয়ারা বেগম বলেন, হামলার আগের রাতেই কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে টাকা দেওয়া হয়েছিল হামলা ঠেকানোর জন্য। কিন্তু কারও বিবেক জাগেনি। উল্টো হামলাকারীরা বাড়িঘর, দোকান এমনকি পানির টিউবওয়েল পর্যন্ত ভেঙে নিয়ে গেছে।
হামলার দিন আলেক শাহ’র মেয়ে কানন রান্নাঘরে ছিলেন। উত্তেজিত জনতা বাড়ি ঘিরে ফেললে তিনি মাজারের পেছন দিয়ে প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। কাননের ভাষায়, “যদি আরও কয়েকজন প্রতিবেশী রেজাউলের মতো সাহস দেখাতেন, এত বড় ধ্বংসযজ্ঞ হতো না।”
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হামলার আগেই তারা পুলিশকে জানালেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং কেউ কেউ টাকা আদায়ের সুযোগ নিয়েছেন। আলেক শাহ জানান, থানার এক এসআইকে ৪০ হাজার টাকা এবং স্থানীয় কয়েকজনকে আরও টাকা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও হামলা ঠেকেনি।
এদিকে হোমনা থানার এসআই তাপস কুমার সরকার বাদী হয়ে অজ্ঞাত ২২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এরই মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, পুলিশ যাকে পাচ্ছে তাকেই সন্দেহ করছে। অথচ প্রকৃত হামলাকারীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা দরকার।
আসাদপুরের ভুক্তভোগীরা এখনো সহায়তার অপেক্ষায়। নির্বাহী কর্মকর্তা ক্ষেমালিকা চাকমা জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের কিছু টিন ও নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে এবং নিরাপত্তায় টহল জোরদার করা হয়েছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হবে, নিরপরাধ কেউ ভুক্তভোগী হবে না।
একজনের অপরাধের দায় নিয়ে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত নয়। আসাদপুরের চারটি মাজার ধ্বংস হওয়া মানে শুধু ইট-পাথরের ক্ষতি নয়, বরং স্থানীয় মানুষের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য, ইতিহাস আর সামাজিক সম্প্রীতির উপর এক নির্মম আঘাত।