পুরস্কারের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তিন সপ্তাহ পার হলেও পুলিশের বেহাত হওয়া ১,৩৫৩টি অস্ত্রের কোনো খোঁজ মেলেনি। লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার, কিন্তু তা সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। এ পরিস্থিতি নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের ৪৬০ থানা, ১১৪ ফাঁড়ি, বিভিন্ন পুলিশ বক্স ও গণভবন ও সংসদ ভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা হয়। এতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি বিপুল অস্ত্র ও গুলি লুট করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে, মোট ৫ হাজার ৭৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬ লাখ ৫২ হাজার ৮৩২ রাউন্ড গুলি লুট হয়েছিল। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ৪ হাজার ৪১০টি অস্ত্র ও ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৩৪৯ রাউন্ড গুলি। কিন্তু এখনও বেহাত রয়ে গেছে ১,৩৫৩টি অস্ত্র এবং প্রায় ২ লাখ ৫৭ হাজার গুলি।
লুণ্ঠিত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে চায়না রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি, পিস্তল, শটগান, গ্যাসগান, টিয়ারগ্যাস লঞ্চার, টিয়ারগ্যাস শেল, সাউন্ড গ্রেনেডসহ নানা ধরনের সরঞ্জাম। এসব অস্ত্রের একাংশ ইতোমধ্যে অপরাধীদের হাতে ধরা পড়েছে। বিভিন্ন ঘটনায় খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হয়েছে লুটের অস্ত্র। গত বছরের নভেম্বরে মুন্সীগঞ্জে তরুণী শাহিদা আক্তারকে হত্যা থেকে শুরু করে ঢাকার বাড্ডা ও মিরপুরে হত্যাকাণ্ড ও ছিনতাই—সব ক্ষেত্রেই লুটের অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে।
পুলিশের দাবি, অপরাধীদের কাছ থেকে কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হলেও মূল অংশ এখনও আন্ডারওয়ার্ল্ড ও সন্ত্রাসীদের হাতে ঘুরছে। গোয়েন্দারা আশঙ্কা করছেন, এসব অস্ত্র অনেক রাজনৈতিক নেতাদের কাছেও পৌঁছেছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে লুণ্ঠিত অস্ত্র ব্যবহার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ২৫ আগস্ট ঘোষণা দেয়, উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদের তথ্যদাতাকে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হবে। পিস্তল ও শটগানের জন্য ৫০ হাজার টাকা, চায়না রাইফেলের জন্য ১ লাখ, এসএমজির জন্য ১.৫ লাখ, এলএমজির জন্য ৫ লাখ এবং প্রতিটি গুলির জন্য ৫০০ টাকা পুরস্কার নির্ধারণ করা হয়। তবে প্রায় তিন সপ্তাহ পরও উল্লেখযোগ্য কোনো সাড়া মেলেনি।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধারে ব্যর্থ হওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “এসব অস্ত্র নির্বাচনে ব্যবহার হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও জননিরাপত্তা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।” নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, “অপরাধীরা জানে এসব অস্ত্র দিয়ে অপরাধ করলে সহজে ধরা যাবে না। ফলে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।”
এদিকে কারা অধিদপ্তরের তথ্য মতে, আন্দোলনের সময় কারাগার ভেঙে পালানো ২,২০০ বন্দির মধ্যে ৭০০ জন এখনও পলাতক। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও জঙ্গি আসামিও আছে। ধারণা করা হচ্ছে, তারাও লুটের অস্ত্র সংগ্রহ করেছে।
অভিজ্ঞ মহল মনে করছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে সেনাবাহিনী ও যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে ভিন্ন কৌশলে অভিযান চালানো ছাড়া অস্ত্র উদ্ধারের কার্যকর উপায় নেই। যতদিন এসব অস্ত্র উদ্ধার না হবে, ততদিন জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা হুমকির মুখে থাকবে।