ঢাকার মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এক সন্ধ্যাতেই ঘরছাড়া হয়েছেন হাজারো মানুষ। ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, মঙ্গলবার বিকেলে লাগা আগুনে দেড় হাজারেরও বেশি ঘর পুড়ে ছাই হয়েছে। সোয়া পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট।
তবে ততক্ষণে শীতের রাতে হাজারো পরিবার খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, নিঃস্বতার বেদনায় কাঁদছিলেন তারা।
বারিধারায় গৃহকর্মীর কাজ করা হোসনে আরা দুই সন্তানসহ হারিয়েছেন সবকিছু। ১৩ বছরের পরিশ্রমে গড়া সংসার—টিভি থেকে ফ্রিজ, প্রয়োজনীয় সবই—এক মুহূর্তে আগুনে ভস্মীভূত। তিনি বলেন, “এক কাপড়ে দুই পোলাপন লইয়া বাইর হইছি। একটা সুতাও নিতে পারি নাই।” তার ছেলে ও মেয়ে—দুজনেরই পরীক্ষা চলছিল, কিন্তু তাড়াহুড়োয় কোনো বইও বের করতে পারেননি।
ময়মনসিংহের মরিয়মও তার ছয় সন্তানের সঙ্গে কড়াইলেই দশ বছর ধরে থাকতেন। আগুন লাগার সময় তিনি ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে ঘরে ছিলেন। কিছুই নিতে পারেননি। কাজের বাসায় গিয়ে কিছু পুরাতন জামাকাপড় পেয়েছেন, সেগুলো নিয়েই আবার বস্তির সামনে বসে আছেন—কী করবেন, কোথায় থাকবেন তা জানেন না।
বস্তিবাসীর অধিকাংশই একই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন—জীবন বাঁচাতে ঘর ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসা, আর ফিরে গিয়ে শুধু ছাইভস্ম দেখতে পাওয়া। কেউ ফ্রিজ, কেউ টিভি, কেউবা কিস্তিতে কেনা নতুন আসবাব হারিয়ে হতবিহ্বল।
চার মাস আগে ধার-সুদে টাকা এনে ঘর তৈরি করা সামিউল ইসলাম আকাশ বলেন, “ফ্রিজ, টিভিসহ সব গুছাইছিলাম কিস্তিতে। এখন সব ছাই।” ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে পরিচ্ছন্নতাকর্মী লিটনও পাঁচ বছরের সংসার হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, বস্তির গলিগুলো অতি সংকীর্ণ হওয়ায় প্রথমে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়েছে। যানজট ও রাস্তায় যত্রতত্র ছোট গাড়ি পার্কিং থাকায় বড় ইউনিটগুলো ঢুকতে পারেনি। ফলে দূর থেকে দীর্ঘ পাইপ টেনে পানি ছিটাতে হয়েছে। পানি সংকট মোকাবেলায় সেচপাম্প বসিয়ে নালা থেকে পানি তুলে আগুন নেভানোর চেষ্টা চলে।
সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, বস্তিটি অত্যন্ত ঘিঞ্জি; টিন, বাঁশ ও কাঠের গায়ে গা লাগানো ঘর হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। উৎপত্তি কারণ এখনও তদন্তাধীন থাকলেও সিলিন্ডার, বৈদ্যুতিক তারসহ সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে।
আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস বাধার মুখেও পড়ে। নিজের ঘর রক্ষায় অনেকেই পানির পাইপ কেটে নিজের দিকে নেওয়ার চেষ্টা করেন, যা আগুন মোকাবিলায় বিঘ্ন ঘটিয়েছে। তবে কর্মকর্তারা বলেন, দুঃসময়ে এমন আচরণ স্বাভাবিক।
অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের খবর না থাকলেও ঘরহারা মানুষের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। কেউ বলেন, “সব শেষ”; কেউ বারবার চিৎকার করে বলেন, “কোথায় থাকমু?”
ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। তিনি পুনর্বাসনে সরকারের সর্বাত্মক সহায়তা নিশ্চিতের নির্দেশ দেন এবং আগুনের কারণ অনুসন্ধান করে ভবিষ্যতে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ প্রদান করেন।