ঢাকার মিরপুরে আগুনের ভয়াবহতায় যেন আবারও উন্মোচিত হলো নগর জীবনের নির্মম সত্য- জীবনের চেয়ে সস্তা এই শহরে শ্রমিকের প্রাণ। মঙ্গলবার দুপুরে রূপনগরের শিয়ালবাড়ি এলাকার একটি অনুমোদনহীন রাসায়নিক গুদাম থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুন মুহূর্তেই পাশের পোশাক কারখানাটিকে গ্রাস করে নেয়।
তীব্র ধোঁয়া, রাসায়নিকের বিষাক্ত গ্যাস আর বন্ধ ছাদের দরজা সব মিলিয়ে শ্রমিকদের জন্য সেটি এক মৃত্যুকূপে পরিণত হয়। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা যখন ধোঁয়ার ভেতর প্রবেশ করেন, তখন দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার মেঝেতে শুধু পুড়ে যাওয়া শরীর। শনাক্ত করার উপায় নেই, মুখের কোনো রেখাই অবশিষ্ট নেই।
সন্ধ্যা নাগাদ ফায়ার সার্ভিস ১৬টি মরদেহ উদ্ধার করেছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিহতদের সবাই পোশাক শ্রমিক। অনেকেই হয়তো চেষ্টা করেছিলেন ছাদে উঠতে, কিন্তু দরজা বন্ধ ছিল তালাবদ্ধ। কেউ কেউ শেষ মুহূর্তে জানালার দিকে ছুটেছিলেন, কিন্তু ধোঁয়া ও উত্তাপে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরে আগুন তাদের গিলে নেয়।
স্থানীয়দের কেউ কেউ বলছেন, প্রথম বিস্ফোরণ হয় গুদামের ভেতরে থাকা রাসায়নিক ড্রামের। মুহূর্তের মধ্যে পুরো ভবন কেঁপে ওঠে, তারপর আগুন ছড়িয়ে পড়ে পোশাক কারখানায়। রাসায়নিকের দাহ্য ধোঁয়ায় পুরো এলাকা ঢেকে যায়। যারা বাইরে ছিলেন, তারাও ভয়াবহ গন্ধে শ্বাস নিতে পারছিলেন না। এক নারী শ্রমিকের ভাই বলেন, “আমার বোন ফোন দিয়া কইছে ‘ভাইয়া দরজা বন্ধ, আমরা উপরে উঠতেছি না।’ তারপরই লাইনটা কেটে যায়।”
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “কারখানার ছাদের দরজায় তালা ছিল, এটিই সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। শ্রমিকরা ধোঁয়ায় অজ্ঞান হয়ে আগুনে পুড়ে মারা যান। ভবনটির কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না।” ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহেদ কামাল বলেন, “এখানে কোনো অনুমোদনই ছিল না। এটি একদিকে রাসায়নিক গুদাম, অন্যদিকে পোশাক কারখানা দুটো মিলিয়ে একটি মৃত্যুফাঁদ।”
মৃত শ্রমিকদের স্বজনেরা হাসপাতাল চত্বরে শোকবিহ্বল হয়ে অপেক্ষা করছেন। কেউ কান্না থামাতে পারছেন না, কেউ অচেতন হয়ে পড়ছেন বারবার। একজন বৃদ্ধা ফুঁপিয়ে বলছিলেন, “ছেলেটা সকালে হেসে বিদায় নিছে। এখন তার চেহারা দেখতেও পারতেছি না।”
রূপনগরের এই আগুন শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়; এটি বাংলাদেশের নগর জীবনের গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। যেখানে অরক্ষিত শ্রমিকরা প্রতিদিন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন, সেখানে মালিকদের দায়বদ্ধতা ও প্রশাসনের নজরদারির অভাব বারবার এই করুণ চিত্র তৈরি করছে। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর শোক, তদন্ত আর প্রতিশ্রুতি—কিন্তু কিছুদিন পর আবার সবকিছু আগের মতোই ফিরে যায়।
রাত নামলেও রূপনগরের আকাশে এখনও ভাসছে ধোঁয়ার গন্ধ, আর বাতাসে মিশে আছে অগণিত পরিবারের কান্না। একসময় এই শহর থেকে সেই গন্ধ মিলিয়ে যাবে, কিন্তু তাদের হারানো মুখগুলো থেকে যাবে এই নগরীর বিবেকের গায়ে দগদগে দাগ হয়ে।