বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল। সোমবার (৬ অক্টোবর) রাজধানীর এক পাঁচতারকা হোটেলে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে তার নাম ঘোষণা করা হয়। সঙ্গে সহসভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন শাখাওয়াত হোসেন এবং ফারুক আহমেদ।
তিন বছর মেয়াদে দায়িত্ব পাওয়া বুলবুল গত মে মাসে অন্তর্বর্তীকালীনভাবে সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এবার নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বোর্ডের শীর্ষ পদে বহাল হলেন। সভাপতির পদে অন্য কোনো প্রার্থী না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় নিশ্চিত হয় তার।
এবারের নির্বাচনে মোট ১৯১ জন ভোটার তালিকাভুক্ত ছিলেন, তবে ভোট দেন ১১৫ জন। নির্বাচনে ৭৩.৭১ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত হয়েছেন ২৩ পরিচালক—এর মধ্যে জেলা ও বিভাগীয় কোটায় ১০ জন, ঢাকার ক্লাব কোটায় ১২ জন, এবং সাবেক ক্রিকেটার ও সরকারি প্রতিনিধি কোটায় একজন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ থেকে মনোনীত হয়েছেন আরও দুজন।
ঢাকা বিভাগের কোটায় পরিচালক হয়েছেন বুলবুল নিজেই, সঙ্গে নাজমুল আবেদিন ফাহিম। অন্যদিকে খুলনা থেকে আব্দুর রাজ্জাক রাজ ও জুলফিকার আলি খান, চট্টগ্রাম থেকে আহসান ইকবাল চৌধুরী ও আসিফ আকবর, বরিশাল থেকে শাখাওয়াত হোসেন, সিলেট থেকে রাহাত শামস, রাজশাহী থেকে মোখলেসুর রহমান এবং রংপুর থেকে হাসানুজ্জামান নির্বাচিত হয়েছেন।
ক্লাব কোটায় নির্বাচিতদের মধ্যে রয়েছেন ইশতিয়াক সাদেক, ফারুক আহমেদ, আমজাদ হোসেন, মেহরাব আলম চৌধুরী, আবুল বাশার শিপলুসহ ১২ জন। সাবেক ক্রিকেটারদের কোটায় নির্বাচিত হয়েছেন খালেদ মাসুদ পাইলট।
তবে ভোটের ফল ঘোষণার পর আবারও নির্বাচনের পূর্ব থেকেই শুরু হওয়া বিতর্ক ও অনিয়মের অভিযোগ সামনে এসেছে। বহু প্রার্থী অভিযোগ করেছেন, পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াই ছিল “পরিকল্পিত” এবং “সরকারি প্রভাবাধীন”।
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল আগেই বলেছিলেন, “যদি বিসিবি নির্বাচন ফিক্স হয়, তবে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।” তার সেই আশঙ্কা যেন বাস্তবে রূপ নিয়েছে, এমন মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকেরা।
পরাজিত প্রার্থী ও ক্রিকেট সংগঠক দেবব্রত পাল বলেছেন, “এই নির্বাচন শুধুমাত্র ফিক্সিং নয়, এর ভেতরে আরও গভীর কিছু ঘটেছে।”
তার দাবি, “বেশিরভাগ কাউন্সিলরই বোর্ডের চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী। তাদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ ছিল না।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, “এই নির্বাচনের অনিয়মের সঙ্গে দেশের ক্রীড়ার সর্বোচ্চ ব্যক্তি (ক্রীড়া উপদেষ্টা) সরাসরি যুক্ত ছিলেন।”
অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কাউন্সিলর মনোনয়ন প্রক্রিয়া। বেশ কয়েকটি জেলা ও বিভাগে মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়সীমা দুইবার বাড়ানো হয়, যা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
এছাড়া ঢাকা মহানগরের ১৫টি ক্লাবের ভোটাধিকার স্থগিত, পুনর্বহাল ও আবার স্থগিত হওয়ার নাটকীয়তা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আরও বিতর্কিত করে তোলে। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের এক চেম্বার বিচারপতির নির্দেশে ওই ক্লাবগুলোর ভোটাধিকার ফেরে, কিন্তু ততক্ষণে প্রার্থীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়ে যায়।
রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগও নতুন নয়। বিসিবির সংবিধান অনুযায়ী, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) সরাসরি দুজন পরিচালক মনোনীত করতে পারে। এই কাঠামোগত নির্ভরতা বোর্ডকে সব সময় রাজনৈতিক প্রভাবের আওতায় রাখে—এমনই মত দিয়েছেন ক্রিকেট বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) কাছে বহুবার সংস্কারের অঙ্গীকার করেও বিসিবি কাঠামোগত বিকেন্দ্রীকরণে ব্যর্থ হয়েছে। এখনও ক্লাব রাজনীতি বোর্ডের মূল নিয়ন্ত্রণে, এবং বড় ক্লাবগুলোর প্রভাবেই বেশিরভাগ পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন।
অভিজ্ঞ সংগঠকদের ভাষায়, “যা হতে পারত সংস্কারের নির্বাচন, তা আবারও ক্ষমতার পুনরাবৃত্তির মঞ্চে পরিণত হয়েছে।” তাদের দাবি, “অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অন্তত একটি স্বচ্ছ নির্বাচন প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু এবারও পুরনো নিয়মেই নাটকের পর্দা উঠেছে। এমনকি এই সরকার পূর্ববর্তী সকল অনিয়মের সীমাকে ছাড়িয়ে গিয়ে দেশের ক্রিকেট বোর্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত, অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা করেছে।”
বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই নির্বাচনের ফল যেমন পূর্বানুমিত ছিল, তেমনি প্রশ্নও পুরনো— ‘বিসিবির নেতৃত্ব কি সত্যিই পরিবর্তন চায়, নাকি শুধু নামের পুনরাবৃত্তি?’