২০০০ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটা চেনা দৃশ্য ছিল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে টিকে থাকার লড়াই, জয়ের আশা নয়। টেস্টে পাঁচ দিন টিকে থাকা, ওয়ানডেতে ৫০ ওভার ব্যাট করা, এটাই ছিল সাফল্যের মানদণ্ড। দুই দশক পর ২০২৫ সালে এসে মনে হচ্ছে, সেই সময়টাই যেন ফিরে এসেছে।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল লজ্জাজনক। তিন ম্যাচে হোয়াইটওয়াশ, শেষ ম্যাচে ২৯৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে ৯৩ রানে অলআউট এমন আত্মসমর্পণ ক্রিকেট ইতিহাসে দুর্লভ। দলীয় মনোভাব, অ্যাপ্রোচ, ব্যাটিং টেকনিক সবকিছুতেই একরকম আত্মবিশ্বাসহীনতা ফুটে উঠেছে।
এই ব্যর্থতা কেবল এক সিরিজের নয়, বরং দীর্ঘদিনের সংকটের প্রতিফলন। শেষ ১২ ওয়ানডে ম্যাচে ১১টিতে হার, বাংলাদেশ এমন সংকটে শেষবার পড়েছিল প্রায় এক যুগ আগে। কিন্তু এখনকার ব্যর্থতা আরও ভয়াবহ, কারণ দলটি অভিজ্ঞতা, সম্পদ ও সুযোগ সবকিছুই থাকার পরও ব্যর্থ হচ্ছে।
খেলার মাঠে আত্মসমর্পণের মানসিকতা
বাংলাদেশ দল এখন এমন মানসিক অবস্থায় আছে যেখানে ৫০ ওভার খেলাই দুই যুগ আগের সময়ের মতোই আবারও ‘লক্ষ্য’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ নিজেই বলেছেন, “আমাদের ৫০ ওভার ব্যাট করতে হবে।” এটা শুধু পরিসংখ্যান নয়, মানসিক অবস্থার প্রতিফলন।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে তৃতীয় ম্যাচে ইনিংস টিকেছিল মাত্র ১৬৩ বল। এর মধ্যে ৯৩ বলই ডট অর্থাৎ প্রায় ৫৭% বলেই রান হয়নি। ওপেনার সাইফ হাসান ছাড়া কেউই দুই অঙ্কে যেতে পারেননি। টপ অর্ডারের ব্যাটাররা রশিদ খানের নাম শুনেই কুঁকড়ে গেছেন। ভয়, আত্মবিশ্বাসহীনতা, পরিকল্পনার অভাব সব মিলিয়ে এক অসহায় দলীয় চিত্র।
টিম ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনাহীনতা
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কিত। হঠাৎ করে খেলোয়াড় পরিবর্তন, স্থায়ী অধিনায়কত্বের অভাব, ব্যাটিং অর্ডারে বিভ্রান্তি সব মিলিয়ে দল হারিয়েছে ধারাবাহিকতা। ১২ ম্যাচে ১১ হার কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং ব্যর্থ নীতির ফল।
দল নির্বাচনে স্বজনপ্রীতি, লবি ও রাজনৈতিক প্রভাব এখন প্রকাশ্য গোপন। পারফরম্যান্সের চেয়ে প্রভাব বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একবার ভালো খেললেই কেউ বাদ, আবার হঠাৎ করেই কেউ দলে আসে “অদ্ভুত কারণে।” ক্রিকেটারদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে, যা মাঠে আত্মবিশ্বাসের অভাবে রূপ নিচ্ছে।
সরকার ও বিসিবির অস্বাস্থ্যকর মেলবন্ধন
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আনুষ্ঠানিকভাবে স্বশাসিত সংস্থা হলেও বাস্তবে সরকারের প্রভাবই মুখ্য। বিসিবির সভাপতি পদটি এখন অনেকটা রাজনৈতিক নিয়োগের মতো। ক্রিকেট প্রশাসন নীতিনির্ধারণের জায়গা হারিয়ে পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রতিযোগিতায়। নীতি বহির্ভূতভাবে ক্রীড়া উপদেষ্টা বিসিবিতে পরপর দুইজন বোর্ড সভাপতি নিয়োগ করেন এবং সাম্প্রতিক বোর্ড নির্বাচনে নগ্ন হস্তক্ষেপ করেন যা নিয়ে দেশের ক্রীড়াজগতে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বোর্ডের বেশিরভাগ পরিচালক রাজনৈতিকভাবে নিয়োজিত ব্যক্তি, যারা খেলার চেয়ে প্রভাব বিস্তার নিয়েই ব্যস্ত। এর ফলে কোচিং, টিম সিলেকশন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মতো মৌলিক বিষয়ে কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গড়ে উঠছে না।
এমনকি কোচ ও নির্বাচক কমিটিতেও সরকারের প্রভাব দেখা যায়। যার ফলে মাঠের পারফরম্যান্স নিয়ে সৎ বিশ্লেষণ, আত্মসমালোচনা বা সংস্কারের সুযোগ হারিয়ে যাচ্ছে। যে বোর্ডের সদস্যরাই সরকারের অনুমোদিত ‘রাজনৈতিক প্রতিনিধি’, তাদের কাছে দলের ব্যর্থতার দায় নেওয়া অবাস্তব প্রত্যাশা।
সর্বশেষ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচনকে 'একপেশে' ও 'অস্বচ্ছ' আখ্যা দিয়ে ৪০টিরও বেশি ক্লাব ক্রিকেট বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে করে দেশের ক্রিকেটের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। নির্বাচনের আগে থেকেই এই নির্বাচনকে ঘিরে ছিল নানা প্রশ্ন এবং শেষ পর্যন্ত একটা পক্ষ সরে দাঁড়ানোর পরে এই নির্বাচন কতোটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন সাবেক ক্রিকেটার ও ক্লাবগুলোর সাথে সম্পৃক্তরা।
বিশ্লেষণ নয়, অজুহাত সংস্কৃতি
প্রতিটি পরাজয়ের পর একই কথা “আমরা চেষ্টা করছি, সময় লাগবে।” অথচ ২০ বছর ধরে সময়ই কেটে যাচ্ছে। বর্তমান খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স গ্রাফ প্রমাণ করে, উন্নতির চেয়ে অবনতি বেশি। ২০২৫ সালে অন্তত পাঁচটি ওয়ানডে খেলা ব্যাটারদের মধ্যে মাত্র দুজনের গড় ৩০-এর ওপরে, তৌহিদ হৃদয় ও জাকের আলি অনিক। বাকি সবাই ২০-এর নিচে।
এ অবস্থায় আফগানিস্তানের মতো দলদের কাছে টানা পরাজয় কেবল খেলার পরিসংখ্যান নয়, বরং একটি মানসিক পতনের প্রতীক।
সমাধান কোথায়?
বাংলাদেশ ক্রিকেটের পুনর্জাগরণ শুরু হতে হবে কাঠামোগত সংস্কার থেকে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট একসময় বিশ্বের বড় দলগুলোর বিপক্ষে সমীহ আদায় করেছিল। আজ সেই দলই ২০০ রানের ব্যবধানে আফগানিস্তানের কাছে হারছে। এর দায় কেবল খেলোয়াড়দের নয়, বরং প্রশাসনিক ব্যর্থতার, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের, আর আত্মসমালোচনার অনুপস্থিতির।
এখন সময় এসেছে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আসলেই ‘বোর্ড’ হয়ে উঠুক, কোনো রাজনৈতিক অঙ্গ না। নইলে ক্রিকেটের এই অবনতি শুধু মাঠে নয়, মানসিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আরও গভীর হবে।