দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ বেড়ে সাধারণ মানুষের জীবনকে করছে অনিরাপদ। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ৫৪০টি হত্যা, দস্যুতা, ডাকাতি ও নারী-শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে। গত বছরের গড় ছিল মাসে ৪৪৫টি। অর্থাৎ এ বছর গড়ে মাসে ৯৫টি মামলা বেড়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করা হয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর। কিন্তু সরকারের ১৩ মাস পরও পরিস্থিতির উন্নতির বদলে অবনতি হওয়ায় জনমনে বাড়ছে নিরাপত্তাহীনতা।
অপরাধ বাড়ছে পরিসংখ্যানে
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি আট মাসে খুন ও ডাকাতি-দস্যুতার মামলাই বেশি। এ সময় মোট মামলা হয়েছে চার হাজার ৩১৬টি। এর মধ্যে খুনের মামলা দুই হাজার ৬১৪টি এবং ডাকাতি-দস্যুতার মামলা এক হাজার ৭০২টি। আগের বছর পুরো বছরে এসব মামলার সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার ৩৩৪টি। অর্থাৎ চলতি বছরের প্রথম আট মাসেই অপরাধের মাত্রা আগের বছরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
একই সময়ে অপরাধবিষয়ক মাসিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাত ধরনের অপরাধমূলক ঘটনায় গত ১৩ মাসে মামলা হয়েছে ৩৯ হাজার ৯৩৬টি। অর্থাৎ মাসে গড়ে ৩ হাজার ৭২টি মামলা, প্রতিদিন গড়ে ১০২টি মামলা।
চাঁদাবাজি চরমে
খুন ও ডাকাতির পাশাপাশি চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলায় নীরবে কিংবা প্রকাশ্যে চলছে চাঁদা আদায়। ব্যবসায়ী, পরিবহন মালিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই এর শিকার। নওগাঁ থেকে ঢাকায় মাল আনতে যাওয়া এক ট্রাকচালক জানিয়েছেন, কয়েক ধাপে চাঁদা দিতে হয়।
নরসিংদীতে চাঁদাবাজদের হামলায় আহত হয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন। তাকে লাঠি ও রড দিয়ে মারধর করা হয়। ঘটনায় সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও চক্রের বাকি সদস্যরা এখনো সক্রিয়।
এ ছাড়া “সমন্বয়ক” পরিচয়ে নতুন ধরনের চাঁদাবাজি চলছে। সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে চাঁদার টাকা নিতে আসা কয়েকজন তরুণকে পুলিশ আটক করে। তারা মিথ্যা মামলা দিয়ে চাঁদা আদায় ও মামলা বাণিজ্যে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
ক্রমবর্ধমান সহিংসতা
চাঁদাবাজির প্রতিবাদে সাভার, মিরসরাই, আশুলিয়া, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে চাঁদা না দেওয়ায় খুনের ঘটনাও ঘটছে। যেমন, চট্টগ্রামের রাউজানে চাঁদা না পেয়ে সন্ত্রাসীরা এক ঠিকাদারকে গুলি করে হত্যা করে।
এ ছাড়া বাগেরহাটে সাংবাদিক খুন, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে দুর্ধর্ষ ডাকাতি, গেণ্ডারিয়ায় এক নারীকে কুপিয়ে হত্যা, ধানমণ্ডি লেক থেকে তরুণের লাশ উদ্ধার, খুলনায় যুবক খুন—এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটছে নিয়মিত।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদন বলছে, সেপ্টেম্বর মাসেই গণপিটুনিতে মারা গেছে ২৪ জন। একই মাসে খুন হয়েছে ৮৩ নারী এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫৩ জন। খালবিল ও ঝোপঝাড় থেকে উদ্ধার করা হয়েছে অন্তত ৫২টি অজ্ঞাত লাশ।
পুলিশের পদক্ষেপ ও সরকারের অবস্থান
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। ১৫ জুলাই থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখল মামলায় ৬৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি রাজনৈতিক পরিচয়ের বলে জানা গেছে। আইজিপি বাহারুল আলম জানিয়েছেন, কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
অন্যদিকে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ৫ আগস্টের পর দেশে চাঁদাবাজি বেড়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, বেকারত্ব, সামাজিক বৈষম্য ও নৈতিক স্খলন অপরাধ বাড়াচ্ছে।
অপরাধ দমন নিয়ে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ থাকলেও মাঠপর্যায়ে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশ্লেষকদের মতে, শুধু পুলিশি অভিযান নয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত না করলে অপরাধ ও চাঁদাবাজির দমন সম্ভব হবে না।