অপহরণ এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং প্রতিদিনের সংবাদে স্থান করে নিয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৯২১টি অপহরণের মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। এর মানে প্রতিদিন গড়ে তিনজনের বেশি মানুষ অপহরণের শিকার হয়েছেন। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, এসব অপহরণের বেশির ভাগ ঘটছে মুক্তিপণ আদায়, প্রতিশোধ, প্রেম-বিবাদ বা ডিজিটাল যোগাযোগের অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে।
অক্টোবর মাস অপহরণের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল। সারা দেশে ওই মাসে ১১০টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। জানুয়ারি মাসে ১০৫টি, ফেব্রুয়ারি ৭৮টি, মার্চ ৮৩টি, এপ্রিল ৮৮টি, মে ৮২টি, জুন ৮০টি, জুলাই ও আগস্টে ৯০টি করে, সেপ্টেম্বর ৯৬টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, অপহরণের হার প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, অপরাধের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে আর্থিক লোভ। মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি, পারিবারিক বা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক বিরোধ, প্রেমঘটিত সমস্যা অপহরণের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখছে। অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ডিজিটাল অপরাধের প্রসার এই প্রবণতাকে আরও তীব্র করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, আগে অপহরণ প্রধানত রাতের অন্ধকারে ঘটত, এখন তা দিনের আলোতেও ঘটছে। অনলাইন রাইডশেয়ারিং, ব্যবসায়িক লেনদেনের সুযোগ বা প্রেম-বিবাদকে ব্যবহার করে অপরাধীরা মানুষকে ফাঁদে ফেলে অপহরণ করছে। এতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে অভিভাবকরা, সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে। রাজধানীর দিয়াবাড়ী এলাকা থেকে ক্যামব্রিয়ান কলেজের শিক্ষার্থী সুদীপ্ত রায়কে অপহরণ করে ৮০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। টাকা না পেয়ে অপহরণকারীরা তাকে হত্যা করে। পুলিশ দুই যুবককে গ্রেপ্তার করেছে। নওগাঁয় এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে ৭০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়; র্যাব অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীকে উদ্ধার ও চক্রের হোতা গ্রেপ্তার করেছে। কক্সবাজারের টেকনাফে কলেজছাত্র হাসান শরীফকে মুক্তিপণ দাবিতে অপহরণ করা হয়, পরে র্যাবের অভিযানেই তাকে উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এএইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, “অপহরণের প্রতিটি ঘটনাকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। সাইবার ইউনিট ডিজিটাল যোগাযোগের মাধ্যমে সংঘটিত অপহরণ রোধে কাজ করছে। সাধারণ মানুষকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে অপরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগে সতর্ক থাকতে এবং সন্দেহজনক কিছু দেখলে নিকটস্থ থানায় বা ৯৯৯ নম্বরে অবিলম্বে জানাতে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশের নিরাপত্তাবোধ পুনঃস্থাপন এবং অপহরণের মাত্রা কমাতে কঠোর আইন প্রয়োগ, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল অপরাধ মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। নীতিমালা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্ত করলে সাধারণ মানুষ সচেতন হয়ে আরও সুরক্ষিত জীবনযাপন করতে পারবে।