সর্বশেষ

জুলাই সনদ

সংবিধানের ঊর্ধ্বে না কি আইনি রূপরেখা? বিতর্কে ঐকমত্য কমিশনের খসড়া প্রস্তাব

প্রকাশিত: ২২ অগাস্ট ২০২৫, ১৯:০১
“কেউ একটি দলিল বানিয়ে বলবে যে, দেশের সবাই সেটা মেনে চলবে—এটা তো সাংবিধানিকভাবে সম্ভব নয়। আইন পাস করতে হলে সংসদ বা সংবিধান সংশোধনের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে।”
সংবিধানের ঊর্ধ্বে না কি আইনি রূপরেখা? বিতর্কে ঐকমত্য কমিশনের খসড়া প্রস্তাব

‘জুলাই সনদ’ নিয়ে দেশে নতুন এক রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সম্প্রতি যে খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে—এই সনদ কি সংবিধান বা প্রচলিত আইনের ঊর্ধ্বে স্থান পেতে যাচ্ছে?

 

ঐকমত্য কমিশন অবশ্য এই ধারণা নাকচ করছে। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ স্পষ্ট করেছেন, সনদে সংবিধান সংশোধনের মতো কিছু সুপারিশ থাকলেও, তা সংবিধানের ওপরে কিছু নয়। বরং তিনি বলেন, “যে প্রস্তাবগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।”

 

বিতর্কের মূল দুই ধারা

 

তবে খসড়ার ‘অঙ্গীকারনামা’র দুটি ধারা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। দ্বিতীয় ধারায় বলা হয়েছেঃ

 

“এই সনদের সকল বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করবো এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সেই ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।”

 

এ বক্তব্য অনেকেই ব্যাখ্যা করছেন সংবিধানের ওপর সনদকে স্থান দেওয়ার প্রয়াস হিসেবে।

 

আর চতুর্থ ধারায় বলা হয়েছে, “জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা, কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।”

 

এই অংশকে সংবিধানে দেওয়া নাগরিকদের বিচার পাওয়ার অধিকার বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী হিসেবে দেখছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

 

‘রক্তে অর্জিত বৈধতা’ বনাম আইনগত বৈধতা

 

আলী রীয়াজ ব্যাখ্যা করেছেন, “সনদের বৈধতা এসেছে আন্দোলনে আত্মদান ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে। ভবিষ্যতে কেউ যদি এই সনদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সেটাকে ঠেকাতেই এই ভাষ্য ব্যবহার করা হয়েছে।”

 

তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, “কেউ একটি দলিল বানিয়ে বলবে যে, দেশের সবাই সেটা মেনে চলবে—এটা তো সাংবিধানিকভাবে সম্ভব নয়। আইন পাস করতে হলে সংসদ বা সংবিধান সংশোধনের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে।” তিনি বলেন, “জুলাই সনদকে আইন রূপে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সেটি সংসদীয় প্রক্রিয়ায় করতেই হবে—তা না হলে এটি সংবিধানের প্রতিস্থাপক হয়ে উঠবে, যা সাংবিধানিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করে।”

 

রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাফ জানিয়েছেন, “জুলাই সনদ একটি রাজনৈতিক সমঝোতা দলিল—একে সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হলে তা একটি খারাপ নজির হবে।” তিনি বলেন, সংবিধান আছে, রাষ্ট্র আছে—এমন বাস্তবতায় সংবিধান অনুযায়ী এ ধরনের প্রস্তাব বাস্তবায়নের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

 

এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত প্রতিশ্রুতিকে ভবিষ্যতে সরকার যেন বাতিল না করতে পারে, সেই কারণে একটি আইনি সুরক্ষা দরকার। তবে দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটি বাস্তবসম্মত পথেই হতে হবে।

 

সাংবিধানিক সুরক্ষা না কি সংবিধানের ঊর্ধ্বে?

 

জুলাই গণ-আন্দোলনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি প্রবল হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে সনদ রচনার উদ্যোগ প্রশংসিত হলেও, এতে প্রস্তাবিত ভাষা ও কাঠামো নিয়ে তৈরি হয়েছে আইনি বিতর্ক।

 

তবে একমত হওয়া যাচ্ছে না—জুলাই সনদ কি ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পথনকশা, নাকি তা সংবিধানের বিকল্প রূপরেখা?

 

সরাসরি সংসদীয় প্রক্রিয়া ছাড়া সংবিধানের ওপরে কোনো দলিলকে স্থান দেওয়ার প্রয়াস, আইনি ও নৈতিক দুই দিক দিয়েই বিতর্কিত হয়ে উঠছে। ফলে, এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য আপাতত দরকার আরেক দফা জাতীয় ঐকমত্য ও আইনি বিশ্লেষণ।

সব খবর