বিশ্বের বড় বড় রপ্তানিকারক দেশগুলো রপ্তানি বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে এবং তা ধরে রাখতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) করে আসছে। এসব চুক্তির ফলে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো একে অপরের বাজারে বিশেষ সুবিধা পায়, যা রপ্তানিতে বাড়তি সুবিধা দেয়। এই প্রক্রিয়ায় যে দেশের কূটনীতি যত শক্তিশালী, সে দেশ ততটা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম ইতোমধ্যেই ৪০টিরও বেশি দেশের সঙ্গে এফটিএ করেছে। যার মাধ্যমে দেশটি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার দখল করে নিচ্ছে। একই পথে এগোচ্ছে কম্বোডিয়া, চীন, ভারত, ফিলিপাইনসহ আরও অনেক দেশ, যারা পিটিএ ও এফটিএর সুবিধায় নানা দেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেছে। তুরস্কও পিছিয়ে নেই—তাদের পিটিএ রয়েছে ১৮টি দেশের সঙ্গে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই দেশের পোশাক শিল্প বিশ্ববাজারে প্রবেশ করেছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের একমাত্র পিটিএ হয়েছে ভুটানের সঙ্গে। এর বাইরে কোনো এফটিএ বা নতুন পিটিএর অগ্রগতি হয়নি। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলে রপ্তানি খাত আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই উত্তরণ তিন থেকে ছয় বছর পেছানোর জন্য চেষ্টা করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এই প্রেক্ষাপটে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, চলতি বছরের ডিসেম্বরেই জাপানের সঙ্গে একটি অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি (ইপিএ) স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এটিই হবে দেশের ইতিহাসে প্রথম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। পাশাপাশি আগামী বছরের নভেম্বরের মধ্যে আরও অন্তত চারটি দেশের সঙ্গে এমন চুক্তি করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ ছাড়া আঞ্চলিক বাণিজ্য জোট আরসিইপি-তে যোগ দেওয়ার দিকেও নজর দিচ্ছে বাংলাদেশ।
তবে এই পরিকল্পনা নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে। কারণ অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচিত নয় এবং দেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক নীতিতে আমূল পরিবর্তন হয়ে থাকে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “আমাদের চ্যালেঞ্জ নিতে হবে এবং সেই মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনায় যেতে হবে। না হলে আমরা রপ্তানি বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়ব।”
সূত্র বলছে, ভিয়েতনাম ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ দেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ভারত, চীন, সিঙ্গাপুরসহ প্রায় ৪০টি দেশের সঙ্গে এফটিএ করেছে। এদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের ইপিএ চুক্তির জন্য ইতোমধ্যেই পাঁচ দফা আলোচনা শেষ হয়েছে। সম্প্রতি টোকিওতে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত পর্যায়ের আলোচনায় অংশ নেয় বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি বাংলাদেশি প্রতিনিধি দল।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ-জাপান যৌথ স্টাডি গ্রুপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইপিএর আওতায় বাণিজ্য, শুল্ক, বিনিয়োগ, ই-কমার্সসহ ১৭টি খাতে চুক্তির রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পণ্য বাণিজ্য, শুল্ক সুবিধা, প্রযুক্তিগত বাধা দূরীকরণ, পরিষেবা বাণিজ্য, সরকারি ক্রয়, মেধাস্বত্ব, পরিবেশ, শ্রম, স্বচ্ছতা এবং বিরোধ নিষ্পত্তি ইত্যাদি।
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার পর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রপ্তানি বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পিটিএ, এফটিএ এবং ইপিএ করতে নীতি গ্রহণ করেছে।
এই ধারাবাহিকতায় আগামী বছরের নভেম্বরের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে চায় সরকার। ভবিষ্যতে এফটিএ চুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, চীন, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ব্রাজিল, থাইল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া ও সৌদি আরবের সঙ্গেও পরিকল্পনা রয়েছে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, “রপ্তানি খাতে প্রতিযোগিতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কোরিয়া, মালয়েশিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে এসব চুক্তি বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার।”