বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে টানা তিন মাস ধরে রপ্তানি কমতির দিকে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে প্রবৃদ্ধি থাকলেও আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে পরপর রপ্তানি কমেছে। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, বৈশ্বিক শুল্ক চাপ, ক্রেতাদের অর্ডার কমে যাওয়া এবং প্রতিযোগী দেশের আগ্রাসী বাজার দখলের কারণে এই ধীরগতি আরও দুই থেকে তিন মাস স্থায়ী হতে পারে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সদ্য প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ। গত বছর একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৩৩০ কোটি ডলারের পোশাক; এবার তা নেমে আসে ৩০২ কোটি ডলারে। অর্থাৎ এক মাসেই কমে যায় ২৮ কোটি ডলারের রপ্তানি। এর আগের দুই মাসেও একই ধারা।
আগস্টে রপ্তানি কমেছে ৪.৭৫ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে কমেছে ৫.৬৬ শতাংশ এবং অক্টোবরে কমেছে ৮.৩৯ শতাংশ। শুধু পোশাক নয়, এর সরাসরি প্রভাবে দেশের সার্বিক রপ্তানিও টানা তিন মাস ধরে কমছে। অক্টোবরে মোট রপ্তানি কমেছে ৭.৪৩%, সেপ্টেম্বরে কমে ৪.৬১% এবং আগস্টে ২.৯৩%।
ওভেন ও নিট—দুই ক্ষেত্রেই ধস
ইপিবির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, শুধু একটি পণ্য প্রকার নয় বরং পোশাকের দুই প্রধান খাতেই রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। এবছরের অক্টোবরে ওভেন পোশাক রপ্তানি ৫.৩৩ শতাংশ কমে ১৪৩ কোটি ডলার থেকে নেমে ১৩৬ কোটি ডলারে নেমেছে। আর, নিট পোশাক রপ্তানি ১০.৭৬ কমেছে।
সেপ্টেম্বর মাসে ওভেন রপ্তানি ৫.৫৪ শতাংশ কমে ১২৮ কোটি ডলার থেকে ১২০ কোটি ডলারে নেমেছে এবং নিট রপ্তানি ৫.৭৫ শতাংশ কমে ১৭২ কোটি ডলার থেকে ১৬৩ কোটি ডলারে নেমেছে।
আগস্ট মাসে মোট রপ্তানি কমেছে ৪.৭৫ শতাংশ। ওভেন পোশাক ২.৬৫ শতাংশ কমেছে এবং নিট পোশাক কমেছে ৬.৩৪ শতাংশ।
কেন কমছে রপ্তানি?
শিল্প উদ্যোক্তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপই সবচেয়ে বড় প্রকোপ তৈরি করেছে। একদিকে পণ্যের চাহিদা কমে গেছে, অন্যদিকে নতুন অর্ডারের হারও ব্যাপকভাবে নিম্নমুখী।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক কাজী মিজানুর রহমান বলেন,
মার্কিন শুল্কই বড় কারণ। আগে একজন ক্রেতা ১০ পিস কিনলে এখন ৫ পিস কিনছে। ফলে আমাদের রপ্তানি অর্ডার কমে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ভারত ও চীন ইউরোপসহ অন্যান্য বাজারে আগ্রাসীভাবে অর্ডার নিচ্ছে। কম দামে পণ্য সরবরাহ করে তারা বাংলাদেশের বাজার অংশীদারিত্বে চাপ তৈরি করছে।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবে পোশাকের অর্ডার কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ক্রেতারা ঝুঁকি কমাতে কম পণ্য অর্ডার করছেন, বড় অর্ডারগুলো ভাগ করে দিচ্ছেন বিভিন্ন দেশে।
নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর সহসভাপতি মোহাম্মদ রাশেদ বলেন,
এখন কঠিন সময় যাচ্ছে পোশাক খাতের। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা নতুন অর্ডার দিতে ভয় পাচ্ছেন। রাজনৈতিক ও আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে আগামী মাসগুলো আরও চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
ব্যবসায়ী নেতারা মনে করছেন, শুল্কের চাপ কমলে ও ক্রেতারা নতুন কাঠামোর সাথে মানিয়ে নিলে বাজার স্বাভাবিক হতে পারে। তবে অর্ডার পুনরুদ্ধার হতে সময় লাগবে। ইউরোপীয় ও মার্কিন বাজার ছাড়া নতুন বাজার সন্ধানে জোর দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। কেউ কেউ আশা করছেন, বড় উৎসব মৌসুম ও শীতের বাজারে ডিসেম্বর-জানুয়ারির দিকে অর্ডার বাড়তে পারে; তবে সেটি নিশ্চিত নয়।
দেশের রপ্তানি আয়েও সরাসরি প্রভাব
টানা তিন মাস রপ্তানি কমায় ডলার আয় কমছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ তৈরি হচ্ছে এবং শিল্পকারখানার উৎপাদন চেইন ধীর হচ্ছে। এতে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান ও কারখানা পরিচালনাও ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।