বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন এক উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দীর্ঘদিন ধরে সংকটে থাকা পাঁচটি বেসরকারি ইসলামী ব্যাংক—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক—একীভূত হয়ে গড়ে উঠছে একটি নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত ইসলামি ব্যাংক। সম্পদের আকারে এটি হবে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত আমানতের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৫২ হাজার কোটি টাকা, বিপরীতে ঋণ ছাড়িয়েছে ২ লাখ কোটি টাকারও বেশি। এর বড় অংশই খেলাপি, ফলে বহুদিন ধরেই ব্যাংকগুলো আমানত ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছিল।
গ্রাহকের অর্থ ফেরত ও নিরাপত্তা
নতুন ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়ায় গ্রাহকের টাকা সুরক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক চালু করছে বিশেষ পেমেন্ট স্কিম। সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত বিমার আওতায় দ্রুত ফেরত দেওয়া হবে। দুই লাখ টাকার বেশি আমানত ধাপে ধাপে ফেরত দেওয়া হবে। একাধিক ব্যাংকে হিসাব থাকলেও বিমার সুরক্ষা সর্বোচ্চ দুই লাখ পর্যন্তই। একীভূত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে আমানতের বিপরীতে ৪ শতাংশ হারে রিটার্ন দেওয়া হবে। পুরোনো আমানত স্কিম বাতিল হবে। প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের নগদ অর্থের পরিবর্তে নতুন ব্যাংকের শেয়ার দেওয়ার চিন্তা চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, যেহেতু ব্যাংক অবসায়ন করা হচ্ছে না, তাই আইন অনুযায়ী আমানতকারী ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের পুরো অর্থ ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “গ্রাহকদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।”
কর্মীদের অনিশ্চয়তা
এই পাঁচ ব্যাংকে কর্মরত প্রায় ২১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন তীব্র অনিশ্চয়তায়। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আশ্বাস দিয়েছেন, “চাকরি হারানোর ভয় নেই, নতুন শাখা খোলা হবে।”
নতুন ব্যাংকের কাঠামো ও মূলধন
একীভূত হওয়ার পর নতুন ব্যাংকের মোট সম্পদ দাঁড়াবে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা—এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা দেবে সরকার, ১০ হাজার কোটি টাকা আসবে ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স ফান্ড থেকে, ৫ হাজার কোটি টাকা আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে।
খেলাপি ঋণ ও দুর্নীতির শেকড়
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৫ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, আর ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা। এসব ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে এস আলম গ্রুপ ও নাসা গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল, যাদের বিরুদ্ধে ভুয়া প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ঋণ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
প্রশাসক নিয়োগ ও শেয়ারবাজারে প্রভাব
পাঁচ ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একীভূত হওয়ার পর ব্যাংকগুলো স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে ডিলিস্ট করা হবে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় ধাক্কা। ইতোমধ্যে শেয়ারের দাম অর্ধেকে নেমে গেছে।
ভবিষ্যৎ চিত্র: সুরক্ষা না ঝুঁকি?
বাংলাদেশ ব্যাংক ‘ব্যাংক রেজ্যুলেশন নীতিমালা’ প্রণয়ন করছে, যেখানে ব্যর্থ ব্যাংক পুনর্গঠন, একীভূতকরণ বা অবসায়নের বিধান থাকবে। ইসলামি ব্যাংকের জন্য কেন্দ্রীয় শরিয়াহ বোর্ড গঠনের সুযোগও রাখা হয়েছে।
সরকার বলছে, এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য গ্রাহকের আমানত সুরক্ষা ও ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন—স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দুর্নীতির লাগাম না টানলে নতুন ব্যাংকও হতে পারে আরেকটি বড় সংকটের উৎস।
এই একীভূতকরণ সফল হলে তা হবে ব্যাংক খাতের জন্য একটি ঐতিহাসিক পুনর্গঠন। তবে এর সাফল্য নির্ভর করবে সুশাসন, জবাবদিহি এবং দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থাপনার ওপর। অন্যথায়, এর দায় শেষ পর্যন্ত পড়বে জনগণের ঘাড়েই।