সর্বশেষ

ঋণ প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানি কমছে, নাজুক হচ্ছে অর্থনীতি

প্রকাশিত: ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:০০
ঋণ প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানি কমছে, নাজুক হচ্ছে অর্থনীতি

বাংলাদেশের অর্থনীতি একাধিক সংকটে জর্জরিত। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি, নতুন এলসি খোলা এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধি—সব সূচকই নিম্নমুখী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দীর্ঘায়িত মূল্যস্ফীতি, গ্যাস সংকট ও ডলারের তারল্য সমস্যা। ইতিমধ্যে সাড়ে তিন শতাধিক ছোট ও মাঝারি কারখানা বন্ধ হয়ে স্থানীয় উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে তীব্র চাপ সৃষ্টি করেছে।

 

ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা বিনিয়োগ পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিনিয়োগকারীরা নতুন প্রকল্পে আগ্রহী নন। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৬.২৯ শতাংশে নেমে এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগও স্থবির। নতুন যন্ত্রপাতি আমদানির ধারা কমে শিল্প সম্প্রসারণে নেতিবাচক সংকেত দিচ্ছে।  

 

বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ মাসে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এতে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন। শুধু সাভারেই ২১৪টি কারখানা বন্ধ হয়ে ৩১ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, শ্রমিক আন্দোলন ও জ্বালানি সংকট শিল্পকে অস্থিতিশীল করছে। ব্যাংকঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগ কমছে, ফলে বেকারত্ব বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.৬৩ শতাংশে। এক বছরে বেকার বেড়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার।  

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবরে ৫৬৪ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ কম। আগের এলসির বিপরীতে বিল পরিশোধও কমেছে ১১ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলার সংকট নয়, বরং বিনিয়োগ ও চাহিদা কমে যাওয়াই দায়ী। রাজনৈতিক অস্থিরতায় বড় শিল্পগোষ্ঠী নতুন প্রকল্পে হাত দিতে ভয় পাচ্ছে।  

 

আইএমএফ মনে করছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৪.৯ শতাংশ। এডিবি বলছে ৫ শতাংশ, আর অন্তর্বর্তী সরকার লক্ষ্য ঠিক করেছে ৫.৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, সংস্কার কার্যক্রম না হলে প্রবৃদ্ধি ৪.৮ শতাংশে সীমিত থাকবে। রাজস্ব আহরণ, ব্যাংক খাত সংস্কার ও বিনিয়োগ পরিবেশে স্বচ্ছতা জরুরি।  

 

ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে রপ্তানি আদেশ সেপ্টেম্বরে তুলনায় ৩৯ কোটি ডলার কমেছে। ঢাকা অঞ্চলে আদেশ কমেছে ১৫ শতাংশ, চট্টগ্রামে ২৬ শতাংশ। জুলাই-অক্টোবর সময়ে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৮.৫ শতাংশে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। তৈরি পোশাক শিল্পের প্রবৃদ্ধিও নিম্নমুখী।  

 

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে সরে যাচ্ছেন। গত এক মাসে ডিএসই সূচক ৪২০ পয়েন্ট কমেছে। সর্বশেষ কর্মদিবসে সূচক দাঁড়িয়েছে ৪৭০২ পয়েন্টে। সিএসই সূচকও কমেছে ১৩৩ পয়েন্ট।  

 

ঢাকা সফর শেষে আইএমএফ জানিয়েছে, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও আর্থিক খাত সংস্কার ছাড়া সামষ্টিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে। যুব বেকারত্ব হ্রাস ও অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য বৃদ্ধির জন্য কাঠামোগত সংস্কার অপরিহার্য।  

 

ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া বেসরকারি খাতে গতি ফিরবে না। ইএবি সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতায় সময়মতো পণ্য ডেলিভারি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।  

 

সিপিডির গবেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হলে পুঁজিপাচার বেড়ে যায়। ট্রেজারি কর্মকর্তারা মনে করেন, নির্বাচন শেষে নীতিগত দিকনির্দেশনা পরিষ্কার হলে বিনিয়োগ বাড়বে, এলসি খোলা ও আমদানি গতি ফিরে আসবে।  

 

ব্যবসায়ীরা ব্যাংকঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামানোর দাবি জানাচ্ছেন। বর্তমানে সুদের হার ১৪ শতাংশের ওপরে, যা এসএমই খাতের জন্য অযৌক্তিক। বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ব্যবসার পরিবেশ নেই, নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না।  

 

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বহুমুখী সংকটে। বিনিয়োগ স্থবির, রপ্তানি কমছে, কারখানা বন্ধ হচ্ছে, বেকারত্ব বাড়ছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া কোনো উদ্যোগই সফল হবে না। সময়োচিত সংস্কার ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত না হলে অর্থনীতি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

সব খবর

আরও পড়ুন

দুর্বল নীতি ও অব্যবস্থাপনায় গভীর ঝুঁকিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি

আইএমএফের কড়া সতর্কবার্তা দুর্বল নীতি ও অব্যবস্থাপনায় গভীর ঝুঁকিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি

শেয়ারবাজারে আরও পতন, সূচক সাড়ে ৪ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন

শেয়ারবাজারে আরও পতন, সূচক সাড়ে ৪ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন

সয়াবিন তেল লিটারে বাড়তে পারে ৯ টাকা ২৭ পয়সা

ফের বাড়ছে ভোজ্য তেলের দাম সয়াবিন তেল লিটারে বাড়তে পারে ৯ টাকা ২৭ পয়সা

শুল্কের চাপ ও বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার ধাক্কায় পোশাক খাতজুড়ে উদ্বেগ

টানা তিন মাস রপ্তানি হ্রাস শুল্কের চাপ ও বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার ধাক্কায় পোশাক খাতজুড়ে উদ্বেগ

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০০ কোটি ডলারের সয়াবিন কিনছে বাংলাদেশের তিন শিল্প প্রতিষ্ঠান

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০০ কোটি ডলারের সয়াবিন কিনছে বাংলাদেশের তিন শিল্প প্রতিষ্ঠান

অক্টোবরে রপ্তানি আয় কমেছে ৭.৪৩ শতাংশ

তৈরি পোশাক খাতে বড় ধস অক্টোবরে রপ্তানি আয় কমেছে ৭.৪৩ শতাংশ

নীতিগত সংকট ও বিনিয়োগ অনিশ্চয়তায় বিপর্যস্ত গার্মেন্টস খাত

১২ মাসে ১৮২ কারখানা বন্ধ, কর্মসংস্থানে ধস নীতিগত সংকট ও বিনিয়োগ অনিশ্চয়তায় বিপর্যস্ত গার্মেন্টস খাত

নাজুক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় চলতি ব্যয় মেটাতেও ঋণের ওপর নির্ভরশীল

তীব্র অর্থ সংকটে অন্তর্বর্তী সরকার নাজুক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় চলতি ব্যয় মেটাতেও ঋণের ওপর নির্ভরশীল