দেশের শিল্প ও উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ খরা দিন দিন প্রকট হওয়ার কারণে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে নেমে এসেছে মাত্র দশমিক ১ শতাংশে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একেবারে সর্বনিম্ন। এমনকি কোভিড মহামারীর সময় লকডাউনে শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তখন প্রবৃদ্ধি ছিল দশমিক ২ শতাংশ। বাস্তবে অর্থনীতি স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি বিনিয়োগের এমন পতন চলমান স্থবিরতার গভীর সংকেত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
শিল্প কারখানায় উৎপাদন চাপে
ঢাকার পার্শ্ববর্তী শিল্পাঞ্চলের বড় একটি পাদুকা কারখানা প্রায় দেড় বছর পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে না পারায় সম্প্রতি তাদের একটি ইউনিট বন্ধ ঘোষণা করেছে। একই পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে বস্ত্র শিল্পেও, যেখানে বহু কারখানা তিন শিফট থেকে নামিয়ে দুই শিফটে এসেছে, কেউ কেউ মাত্র একটি ইউনিট চালু রেখেছে। বিটিএমএ’র তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে ২০ থেকে ২২টি বড় কারখানা উৎপাদন স্থগিত বা কম সক্ষমতায় চালাতে বাধ্য হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, রড-সিমেন্ট, টেক্সটাইল, কোমল পানীয়সহ বিভিন্ন খাতে চাহিদা নেই; গ্রামে-গঞ্জে বিদ্যুৎ ঘাটতি; স্থানীয় বাজারে কেনাকাটা কমে গেছে; মূল্যস্ফীতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় দোকান-পাট, রেস্তোরাঁ, পোশাক বিক্রি সবখানেই খরচ কমছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও বিক্রি কমে যাওয়ায় কারখানাগুলো ধুঁকছে।
ঋণপ্রবাহ ও সুদ হারের চাপে বিনিয়োগ স্থবির
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ এখন কোভিডের সময়ের চেয়েও কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেই ঋণ স্থিতি ঋণাত্মক ধারায় নেমে গেছে। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে অনীহ, বরং সরকারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগকেই নিরাপদ ও লাভজনক মনে করছে। নীতি সুদহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে নেওয়া এবং ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশে ওঠায় উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে আগ্রহ হারিয়েছেন।
ব্যাংকাররা বলছেন, অনেকে শিল্প সম্প্রসারণ বা নতুন কারখানা তৈরির ঝুঁকি নিতে চাইছেন না; আবার যারা ঋণ নিতে চান তারাও উচ্চ সুদের চাপে পিছিয়ে আসছেন। এতে বেসরকারি খাতে প্রকৃত ঋণপ্রবাহ প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।
আমদানি কমে যাচ্ছে, নতুন কারখানা স্থাপন প্রায় বন্ধ
নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপনের অন্যতম নির্দেশক মূলধনি যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির এলসির পরিমাণ গত অর্থবছরে ২৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি স্পষ্টই দেখাচ্ছে যে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন না, বরং উৎপাদন টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন।
পুঁজিবাজার-নির্ভর বিনিয়োগও কমে গেছে। গত এক বছরে তালিকাভুক্ত উৎপাদন খাতের মাত্র ১২টি কোম্পানি নতুন বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে, যা এক দশকে সর্বনিম্ন।
রড-সিমেন্ট থেকে টেক্সটাইল—সবখানেই সংকট
সিমেন্ট শিল্পের সক্ষমতার মাত্র ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে; কারণ সরকারি প্রকল্প নেই, অবকাঠামোগত নির্মাণ কমে গেছে, আবাসন স্থবির। রড-সিমেন্ট কারখানাও একই সমস্যায়। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ জানায়, অর্ধেকের বেশি শিল্প কারখানা অর্ধক্ষমতায় চলছে, অনেকে একেবারেই বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মত
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ঐতিহাসিকভাবে এত কম প্রবৃদ্ধি অপ্রত্যাশিত, তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এলে আগামী বছরে কিছু উন্নতি হতে পারে। তিনি মনে করেন, জ্বালানি ঘাটতি দূর করা এবং আর্থিক খাতকে সুশৃঙ্খল না করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
পিআরআই-এর সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিনিয়োগ স্থবিরতা ও রফতানি প্রবৃদ্ধি থেমে যাওয়ার কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমছে। মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও মজুরি বাড়েনি, ফলে ক্রয়ক্ষমতা দুর্বল এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
সামনে কী?
ব্যবসায়ীরা সরাসরি বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা নেই; রাজনৈতিক অস্থিরতা, সুদের চাপ, কাঁচামালের ব্যয়, জ্বালানি সংকট মিলিয়ে বিনিয়োগে কেউ ঝুঁকি নিতে পারছেন না। তারা বিশ্বাস করেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটানো কঠিন হবে।