তীব্র অর্থ সংকটে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজস্ব আদায় কমে যাওয়া, বিগত সরকারের নেওয়া দেশি-বিদেশি ঋণের কিস্তি ও সুদপরিশোধের চাপ এবং দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব—এ তিন কারণে রাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থাপনা নাজুক হয়ে উঠেছে। ফলে সরকারের পরিকল্পিত চলতি খরচও মেটাতে হচ্ছে ঋণ নিয়ে। দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহে কৃচ্ছসাধনের নীতি নিলেও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ বাড়ছে। বিপরীতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও মন্থর হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছে ১.৭৯ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমেছে ০.০৩ শতাংশ। ফলে দুই মাসে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ নেতিবাচক থাকে। রপ্তানি, শিল্প উৎপাদন ও খুচরা-বাণিজ্যে স্থবিরতা এবং বিনিয়োগ ঝুঁকি বাড়ার কারণেই ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ায় সতর্ক। এর বিপরীতে গ্যাস-জ্বালানি আমদানি ও চলতি ব্যয় মেটাতে সরকারকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে।
দেশের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ২৩ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা বেসরকারি খাতে এবং সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা সরকারি খাতে রয়েছে। তবে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধি উৎপাদনশীল নয়, কারণ এই অর্থ মূলত ব্যয় নির্বাহে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা কর্মসংস্থানের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে সরকারি ঋণ বাড়ার তিনটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে—
১) লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হওয়া
২) বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ ঋণের বিপুল কিস্তি ও সুদপরিশোধ
৩) মূল্যস্ফীতি বাড়ায় সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনীর খরচ বৃদ্ধি
রাজস্ব আয় কম থাকায় ঘাটতি বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬১ হাজার ২৬ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৫৪ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ কম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আয় কমায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়াতে হয়েছে, যা অতিরিক্ত ব্যয়ের চাপ তৈরি করেছে। গত কয়েক মাসে সংকট এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে সরকারকে কয়েক দফা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় ঋণ নিতে হয়েছে, যদিও পরে তা পরিশোধ করা হয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে ঋণ না নিয়ে উল্টো দুই হাজার ৫১৭ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে সরকার। তবে নন-ব্যাংকিং খাত—বিশেষ করে সঞ্চয়পত্র ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান—থেকে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, যার সুদহার ১১ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ। এটি অর্থনৈতিক ব্যয়ের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে।
অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণ শোধে ডলার কিনতে গিয়ে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। কিস্তি স্থগিতকরণের সুদও বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট আর আয় কমার কারণে সার্বিক আমানত বেড়েছে মাত্র ১.৪৪ শতাংশ। চলতি আমানত কম হওয়া বাজারে লেনদেন কমে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
এ অবস্থায় আইএমএফ সরকারের ঋণ কমিয়ে উৎপাদনশীল খাতে, বিশেষ করে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। তারা সরকারি ঋণ-নির্ভরতা ও বেসরকারি ঋণপ্রবাহের টানা নিম্নগতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।