দেশের অর্থনীতি এক অনিশ্চিত ও জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি। রফতানি আয় কমছে, মূল্যস্ফীতি ফের ঊর্ধ্বমুখী, আর বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, উচ্চ সুদহার ও জ্বালানির ঘাটতি মিলিয়ে অর্থনীতির চাকা ঘুরছে ধীর গতিতে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে এখন একপ্রকার ‘ভজঘট পরিস্থিতি’ তৈরি হয়েছে।
রফতানি আয়ে টানা পতন
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে দেশের রফতানি আয় টানা দুই মাস কমেছে। আগস্টে রফতানি আয় কমেছে প্রায় ৩ শতাংশ, আর সেপ্টেম্বরে তা আরও ৪.৬১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যদিও চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) মোট রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ১২৩১ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫.৬৪ শতাংশ বেশি।
তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোর এই নিম্নগতি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইপিবি জানায়, তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, পাট ও প্লাস্টিক পণ্যের রফতানি কমেছে, তবে হিমায়িত খাদ্য ও চামড়া খাতে কিছুটা বৃদ্ধি দেখা গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউরোপ–আমেরিকার বাজারে চাহিদা হ্রাস, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রফতানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বিনিয়োগে স্থবিরতা ও ঋণ প্রবৃদ্ধির পতন
বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আগস্টে নেমে এসেছে মাত্র ৬.৩৫ শতাংশে, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ব্যাংকের উচ্চ সুদহার ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে অনীহা দেখাচ্ছেন।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “উচ্চ সুদহার বিনিয়োগের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। নির্বাচনের পর স্থিতিশীলতা ফিরলে বিনিয়োগও বাড়বে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, অনেক ব্যাংক ঋণ দেওয়ার বদলে সরকারি বন্ডে বিনিয়োগে ঝুঁকছে, ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়েছে।
মূল্যস্ফীতি ফের ঊর্ধ্বমুখী
সেপ্টেম্বর মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৩৬ শতাংশে, যা আগের মাসের তুলনায় সামান্য বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে ৭.৬৪ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বেড়ে ৮.৯৮ শতাংশে পৌঁছেছে।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, “বর্ষার প্রভাব ও সরবরাহব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। উৎপাদক থেকে ভোক্তার কাছে সরাসরি সরবরাহ বাড়ানো গেলে দাম কিছুটা কমানো সম্ভব।”
সুদের হার ও শিল্প খাতের উদ্বেগ
বর্তমানে ব্যাংক ঋণের সুদহার ১৪ শতাংশের ওপরে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এফবিসিসিআইসহ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে সুদের হার কমিয়ে এক অঙ্কে নামানোর দাবি জানিয়েছে। গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর আশ্বাস দিয়েছেন, আগামী মুদ্রানীতিতে নীতি সুদের হার ধীরে ধীরে কমানো হবে।
সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, রফতানি পুনরুদ্ধার, বিনিয়োগ পরিবেশ পুনর্গঠন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া এই ‘ভজঘট অর্থনীতি’ থেকে বের হওয়া কঠিন হবে।